"দশটি উপন্যাস" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে যে-শতাব্দী শেষ হওয়ার পথে, তার মধ্যলগ্ন থেকে আশাপূর্ণা দেবী নিজেকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত রেখেছিলেন আমৃত্যু। অনেকের মতে, আশাপূর্ণা কেবল বাংলা সাহিত্যেই নয়, বাঙালির জীবনেও এক বিস্ময়। সকলের চোখের আড়ালে বসে, নিতান্ত ঘরােয়া ও আটপৌরে সংসারের মধ্যে থেকে তিনি যে-বিপুল পরিমাণ কথাসাহিত্য রচনা করেছেন তার যথার্থ মূল্যায়ন এখনও হয়নি। প্রথম প্রচারমাধ্যমের আলাে তাঁর জীবনসংগ্রাম ও সাহিত্যসাধনার ওপর পড়েছিল জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পাওয়ার পর। বাঙালি পাঠক-পাঠিকা সবিস্ময়ে সেদিন জেনেছিল, কোনও আনুষ্ঠানিক শিক্ষা না-পেয়েও এই মহীয়সী নারী কীভাবে কথাসাহিত্যের বরমাল্য আপন আত্মশক্তিতে জয় করেছেন। নারীচরিত্র সৃজনের অসামান্য দক্ষতায়, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠায় এবং বর্ণনারীতির সৌকর্যে আশাপূর্ণা অনন্যা। তাঁর সৃষ্ট নারীরা ব্যতিক্রমী নন, বরং ঐতিহ্যবাহী। কিন্তু সেই ঐতিহ্য তাঁর সৃজনের গুণে বহুব্যাপ্ত স্রোতস্বিনীর মতাে। নারীচরিত্র। অঙ্কনে তিনি কখনই একপেশে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেননি। তাঁর মেয়েরা যেমন নিপীড়নে, অত্যাচারে ক্লিষ্ট, তেমনই তারা হিংস্র, স্বার্থপর, কুটিল এবং অনেকক্ষেত্রেই অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুর। আশ্চর্য নির্মোহ বিশ্লেষণে ও কখনও কখনও তির্যক ব্যঙ্গে আশাপূর্ণা তাঁর নারীচরিত্রগুলিকে রচনা করেছেন। আবার শুধু নারী কেন, পুরুষদের প্রতিও তিনি সমান সহৃদয়া। মােটকথা, নারী ও পুরুষ মিলিয়ে যে-মানুষ, আশাপূর্ণার সমস্ত সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু সে। একটি লেখায় তিনি বলেছিলেন: ‘আমার...সাধ্যের মধ্যে শুধুই মানুষ, মধ্যবিত্ত ঘরােয়া মানুষ, যে আমার একান্ত চেনা জানা। আমি আমার জানা জগতের বাইরে কখনাে হাত বাড়াতে যাই না।' আশাপূর্ণা এই মানুষের, চরিত্ৰনামক জটিল ও গহন অরণ্যে প্রবেশ করেছেন। মানুষের ভাল-মন্দ দুটিকেই দেখেছেন খােলা মন, খােলা চোখ দিয়ে। মানুষ দেখার কাজটা তাঁর নিজের কাছে ছিল একটা বিস্ময়। আশাপূর্ণা এ সম্পর্কে লিখেছেন: দেখতে দেখতে হঠাৎ হঠাৎ যেন কোথায় এক একটা জানলা খুলে যায়, অনুভবে আসে—মানুষের যতটুকু দেখি সেটুকুই তার সব নয়, যেটা দেখিনা সেটাও অনেকখানি।... মানুষ নিজেও জানেনা সেই অনেকখানিটাই তার জীবন আর, জীবনজিজ্ঞাসার নিরন্তর দ্বন্দ্ব। সামগ্রিকভাবে তাঁর গল্প-উপন্যাসের এই মানুষেরা মধ্যবিত্ত বাঙালি। এদেরকে নিয়েই তাঁর সমগ্র সৃষ্টি। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে নানা মূল্যবােধ, যেগুলি বহু ভাঙনেও এখনও বহমান, আশাপূর্ণার সাহিত্যে সেগুলিই চিরস্থায়িত্ব লাভ করেছে। এই সংকলনে আশাপূর্ণার বিপুল স্বর্ণভাণ্ডার থেকে চয়িত হয়েছে ভিন্ন স্বাদের এই দশটি উপন্যাস: গাছের পাতা নীল, দোলনা, রাতের পাখি, সেই রাত্রি এই দিন, সময়ের স্তর, দর্শকের ভূমিকায়, চাঁদের জানালা, লােহার গরাদের ছায়া, এই ততা সেদিন এবং নীল।
Ashapurna Debi (৮ই জানুয়ারি, ১৯০৯ – ১৩ই জুলাই, ১৯৯৫) বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক। ১৯২৪ সালে, মাত্র ১৫বছর ৮ মাস বয়সে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তাঁর রচনার মূল উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ আশাপূর্ণা ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল না। বঞ্চিত হয়েছিলেন প্রথাগত শিক্ষালাভেও। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তি তাঁকে দান করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকার আসন। তাঁর প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা-বকুলকথা উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। তাঁর একাধিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপে ভূষিত করেন। ১৯৯৫ সালে ১৩ জুলাই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।