"প্রেম নেই" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: ম্যাগসেসে পুরস্কার যেদিন ঘােষিত হল, কলকাতায় এসে যে-মুহুর্তে পৌছল সেই খবর, সেদিন, সেই মুহুর্তে, কোথায় ছিলেন গৌরকিশাের ঘােষ? তিনি ছিলেন বাঙালি মুসলিম সাহিত্য সম্মেলনে, প্রধান অতিথি হিসেবে। মুসলিম-জীবন যেভাবে সাহিত্যকর্মে অবহেলিত হয়েছে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বাস্তব ও যুক্তিসম্মতভাবে মুসলিম-জীবনের স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার প্রয়াসে অনুপ্রেরণা দেবার জন্যই। যে-সম্মেলন স্বাধীনতার এত বছর বাদে এই প্রথম অনুষ্ঠিত হল কলকাতায়, সন্দেহ নেই, সেই গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনে গৌরকিশাের ঘােষই যথার্থ প্রধান অতিথি হবার যােগ্য। কেননা, তিনিই .. লিখেছেন মুসলমান-জীবন নিয়ে সুবিশাল এক অন্তরঙ্গ আলেখ্য, যার নাম—‘প্রেম নেই। ‘দেশ-মাটি-মানুষ’ নামে পরিকল্পিত এপিক-ট্রিলজির দ্বিতীয় খণ্ড ‘প্রেম নেই’ ধারাবাহিকভাবে ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হবার সময় থেকেই সাড়া জাগিয়েছে। এ-উপন্যাস পড়তে-পড়তে মনে হয় লেখক বুঝি সফিকুল বা দাউদের আবাল্য সহচর, ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন তাদের সংস্কার ও সংঘাত, জ্বালা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব, প্রেম ও রিরংসা, ধর্ম ও রাজনৈতিক চেতনা—এবং আরও অসংখ্য খুঁটিনাটি যা এর আগে এভাবে কেউ দেখেননি। তিনি যেন আমাদেরও করে নিয়েছেন এদের জীবনযাত্রায় একান্ত প্রতিবেশী, কি গ্রামে, কি শহরে। এবং আমরাও তাই শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাই সেই শাশ্বত সত্যে যেখানে প্রেম নেই’ এই আর্তনাদ প্রতিষ্ঠিত হয় মিথ্যা রূপে।
গৌরকিশোর ঘোষ (২২ জুন, ১৯২৩ - ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০) একজন প্রথিতযশা বাঙালি সাংবাদিক ও সাহিত্যিক। তিনি রূপদর্শী ছদ্মনামে গল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি বাংলাদেশের যশোর জেলায় হাট গোপালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক পড়াশোনা করেন শ্রীহট্ট জেলার এক চা-বাগানে। স্কুলের পাঠ নদিয়া জেলার নবদ্বীপে। ১৯৪৫ সালে আইএস-সি পাশ করেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত গৌরকিশোর ক্রমাগত পেশা বদলে গেছেন। প্রাইভেট টিউটর, ইলেকট্রিক মিস্ত্রী, খালাসি, রেস্তরাঁয় বয়, ট্রেড ইউনিয়ন অর্গানাইজার, ইস্কুল মাস্টার থেকে ভ্রাম্যমান নৃত্য-সম্প্রদায়ের ম্যানেজার, ল্যান্ডকাস্টমস ক্লিয়ারিং কেরানি, প্রুফ রিডার ইত্যাদি অসংখ্য কাজ করেছেন সাংবাদিক জীবনে প্রবেশের আগে পর্যন্ত। স্বাধীনচেতা সাংবাদিক গৌরকিশোর ১৯৭৫ সালের 'মিসা' (MISA) অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ জন-নিরাপত্তা আইনে তাকে গ্রেপ্তার হন। প্রেসিডেন্সি জেলে তাকে বন্দী রাখা হয়। সাংবাদিকদের অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বহু নির্যাতন সহ্য করেও নিরন্তর সংগ্রামের ব্রতী ছিলেন। মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনার জন্যে বুদ্ধিজীবী মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। তার সাহিত্য বাঙলার বিদগ্ধ পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে। আনন্দবাজার পত্রিকায় চাকরি করতেন তিনি। দেশ পত্রিকায় কলাম লিখেছেন। আশির দশকে আজকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। দেশ-মাটি-মানুষ ট্রিলজির দ্বিতীয় খন্ড 'প্রেম নেই' গ্রামীন মুসলিম জীবন নিয়ে সুবিশাল রচনা। দেশ পত্রিকায় এই উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে বের হয়। এছাড়া সাগিনা মাহাতো, জল পড়ে পাতা নড়ে, আনাকে বলতে দাও, আমরা যেখানে, লোকটা, রূপদর্শীর সংবাদভাষ্য ইত্যাদি তার অন্যান্য গ্রন্থ। সাগিনা মাহাতো, তপন সিংহর পরিচালনায় চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন দিলীপ কুমার। গৌরকিশোর সৃষ্ট মজলিশি চরিত্রের নাম ব্রজদা। সাংবাদিকতার জন্যে তিনি ১৯৭৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার 'কো জয় উক' স্মৃতি পুরষ্কার এবং ১৯৮১ সালে ম্যাগসাসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। একই বছর মহারাষ্ট্র সরকারের পুরষ্কার, ১৯৯৩ সালে হরদয়াল হারমোনি পুরষ্কার, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ পুরষ্কার পান। তিনি ১৯৭০ খৃষ্টাব্দে আনন্দ পুরস্কার ও ১৯৮২ তে বঙ্কিম পুরষ্কার পান। কলকাতা মেট্রো রেলের নতুন প্রস্তাবিত চিংড়িহাটা স্টেশনটি গৌরকিশোর ঘোষের স্মৃতিতে রাখা হয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর, ২০০০ সালে মারা যান গৌরকিশোর ঘোষ।