"তিনটি নীললোহিত” বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: আকাশ চিরে নেমে এল এক ঝলক বিদ্যুৎ। পরমুহূর্তে প্রচণ্ড গর্জন। কেঁপে উঠল নীললােহিতের সারা শরীর। তারপরেই এক আশ্চর্য কাণ্ড। বজ্রাঘাতে মৃত্যুর বদলে পুরুষ থেকে সে নারী হয়ে গেছে। এই উদ্ভট পরিবর্তন নীলুকে নিয়ে চলল, নারীদের বিচিত্র জগতে। যেখানে আছে দুঃখ, হতাশ্বাস, যন্ত্রণা, অপমান, যৌনপীড়ন, অত্যাচার, উদ্ধারাশ্রম। সব আছে নেই শুধু ভালবাসা। নারীতে রূপান্তরিত নীললােহিত চেয়েছিল কোনও পুরুষ তাকে ভালবাসুক। কিন্তু পুরুষরা সবাই কি ভালবাসতে ভুলে গেছে? দিকশূন্যপুর ছাড়া কি ভালবাসা আর কোথাও অবশিষ্ট নেই? অনাবাসী বাসবদা প্রতিবছরের মতাে এ বছরেও ঘাের বর্ষায় জুন মাসে নিজের গ্রাম আঙরিপোতায় এসেছেন। সঙ্গে নীললােহিত। একদিন তুমুল বৃষ্টি হল সারা দুপুর। সন্ধেবেলায় বাসবদার কাছে খবর এল একটা পুকুর কাটতে কাটতে উঠে এসেছে মােহর এবং দুর্লভ সব প্রত্নসামগ্রী। বাসবদার ছােটবেলার বন্ধু অখণ্ডর মেয়ে লিলি সবার অলক্ষ্যে নীললােহিতের হাতে তুলে দিল একটি ধাতুৰ মূর্তি। এই মূর্তিটা বিক্রি করে মেধাবী লিলির পড়াশােনায় সহায়তা করতে চাইছে নীলু। এদিকে বাসুদা তার মায়ের নামে গ্রামের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেছেন। কে পাবে সেই বৃত্তি? লিলি, নাকি আঙরিপোতার আর একটি মেয়ে সুনন্দা? শেষ পর্যন্ত এক অনাস্বাদিত মুহূর্তে লিলির হাতে সেই প্রত্নমূর্তিটি ফিরিয়ে দিয়েছে নীলু। কিন্তু কেন? বহু বছর পরে নীললােহিতের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ওর কিশাের বয়সের বন্ধু মানসের। মানস আজ অভাবী, ফেরিওয়ালা। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তার জীবনযাপন। টালির চাল আর ছিটেবেড়ার ঘরে মানসের পরিবারের সঙ্গে এক বর্ষণমুখর রাত্রি কাটিয়ে নীলুর চোখের সামনে ঘটে গেল অনেক গল্প। অনেক চরিত্রায়ণ। তারই মধ্যে মানসের বােন লিলু, যার ভাল নাম জেরিনা। যার জীবন সংশয়ে-সংকটে-যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট। মানস চাইছিল নীলু তার বােনকে বিয়ে করে সেই নরক থেকে উদ্ধার করুক। কিন্তু লিলু চাইল না। কেন, নীললােহিত তাকে নতুনভাবে বাঁচার পথ দেখিয়ে দিল। জেরিনা কি সেইপথ খুঁজে পাবে শেষ পর্যন্ত?
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।