'গল্পসংগ্রহ' বইয়ের ফ্লাপের লেখা অসামান্য জনপ্রিয় গােয়েন্দা কাহিনী এবং সার্থক ঐতিহাসিক আখ্যান রচনার পাশাপাশি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নানা স্বাদের ছােটগল্প লিখেছিলেন। ভৌতিক, অলৌকিক, সামাজিক, প্রেমমূলক কিংবা হাস্যরসাত্মক সেইসব গল্প লেখকের অননুকরণীয়। স্টাইলে সমৃদ্ধ, চিরায়ত সাহিত্যভাবনায় কালজয়ী। তাঁর বহুপঠিত গােয়েন্দা গল্প ও ঐতিহাসিক গল্পগুলির পাশে এদের উপস্থিতি হয়তাে কিছুটা অনুজ্জ্বল বলে মনে হয়। কিন্তু সাহিত্যরসিক মাত্রেই জানেন, বিচিত্ৰস্বাদের এইসব ছােটগল্পে শরদিন্দুর দক্ষতা সেই শীর্ষবিন্দু স্পর্শ করেছে, যেখানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। শরদিন্দু বলতেন, “ছােটগল্পটাই আমার হাতে বেশি আসে। গল্প লেখার সময় সর্বদা মনে রাখি-Brevity is the soul of wit৷ যাই লিখি না কেন যত্ন করে লিখতে হয়। তাঁর এই আপনকথার উজ্জ্বল উদাহরণ ওই নানা রসের ছােটগল্পগুলি। কাহিনী বয়নের উৎকর্ষে, ক্লাসিক্যাল স্বাদু গদ্যের প্রবাহে এবং অনায়াস সরসতার মাধুর্যে এই গল্পগুলি বাংলা গল্পের অন্যতম সেরা সম্পদ। সুকুমার সেন একটি আলােচনায়। দেখিয়েছেন শরদিন্দুর এই সাধারণ গল্পগুলির বৈশিষ্ট্য হল, মনােহরণ-সামর্থ্য’, ‘উপভােগ্যতা’, ‘গদ্যরীতির অনায়াস-সৌষম্য’ এবং গল্পসৃষ্টিতে ‘দুরূহ নিপুণতা। এইসঙ্গে আর একটি বৈশিষ্ট্যও পাঠক লক্ষ করবেন। তা হল পটভূমি ও পরিবেশ রচনা। ভূতের, অলৌকিক এবং সামাজিক গল্পগুলিতে বিহারের মুঙ্গের শহর ও গ্রামাঞ্চল, পুনে ও মহারাষ্ট্রের কিছু জনপদ এবং মরাঠা জীবন যথাযথ প্রতিবিম্বিত হয়েছে। আর মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন ও স্বপ্নময় প্রেক্ষাপট তাে আছেই। ইতিপূর্বে একখণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ব্যোমকেশ সমগ্র এবং ঐতিহাসিক কাহিনীসমগ্র। এবার দুই মলাটের মধ্যে এনে প্রকাশিত হল বিষয়বৈচিত্র্যে ভরপুর শরদিন্দুর অন্যান্য ছােটগল্পসমূহ।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ, ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহরে। তাঁর আদিনিবাস উত্তর কলকাতার বরানগর কুঠিঘাট অঞ্চলে। লেখক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০ বছর বয়সে, যখন তিনি কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস জগতে বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন অমর গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সী, যা প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৩২ সালে 'সত্যান্বেষী' গল্পের মাধ্যমে। শুধু উপন্যাস বা গল্প সংকলন নয়, বাংলা সাহিত্যে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাও কম রেখে যাননি। ২২টি কবিতার সংকলন নিয়ে প্রকাশিত 'যৌবন-স্মৃতি' ছিল তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই। ১৯১৯ সালে তিনি বি. এ. পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতা ছেড়ে সুদূর পাটনায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন এবং সেখানেই আইন নিয়ে পড়াশোনা চালাতে থাকেন। আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে একদম পুরোপুরিভাবে গল্প ও উপন্যাস লেখায় ঝুঁকে পড়েন। ১৯৩৮ সালে পাটনা ছেড়ে মুম্বাই যান বলিউডে কিছু কাজের উদ্দেশ্যে এবং ১৯৫২ সালে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে সমস্ত চুক্তি বাতিল করে মুম্বাই ছেড়ে পুনে চলে আসেন। সেখানে থাকাকালেই একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ যার বেশিরভাগই ছিল ভৌতিক, রোমান্টিক ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কীয় গল্প। ব্যোমকেশ সমগ্র ছাড়াও 'গৌড়মল্লার', 'তুমি সন্ধ্যার মেঘ', 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' এর মতো দুর্দান্ত সব উপন্যাস আছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই এর তালিকায়। শুধু বাংলা নাটক বা চলচ্চিত্র না, তাঁর লেখা ব্যোমকেশ বক্সী জায়গা করে নিয়েছিল হিন্দি টিভি সিরিজ ও হিন্দি চলচ্চিত্রেও। অর্জনের ঝুলিতে অনেক পুরষ্কারের মাঝে তাঁর রয়েছে রবীন্দ্র পুরষ্কার, যা তিনি পেয়েছিলেন 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' উপন্যাসটি লিখে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান শরৎ স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এই লেখকের জীবনাবসান ঘটে।