'আয়নামহল' বইয়ের ফ্লাপের লেখা সে প্রথিতযশা শিল্পী। সে নিবিড় জীবনশিকারি। সে দিব্যজ্যোতি সিংহ। পৃথার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। সে বিয়ে ভেঙেও গেছে। কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতার ভেতর সরু সুতাের মতাে ঝুলে আছে বন্ধনের আভাস। একাধিক আত্মীয়-অনাত্মীয় এমনকী বাড়ির কাজের মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত দিব্যজ্যোতি। এই মহিলাদের যুগপৎ ভালবাসা ও ঘৃণা তার ওপর ঝরে পড়ে। কিন্তু সে অদ্ভুত নির্লিপ্ত। কোনও বন্ধনে, এমনকী অপত্যের ডােরেও সে বাঁধা পড়তে চায় না। দিব্যজ্যোতি শুধু জীবনকে ভােগ করতে চায়। শৈশবে পিতৃহারা দিব্যজ্যোতির মা তার একমাত্র পারিবারিক বন্ধন। যদিও সে তার মা কেউই কারও ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল নয়। খ্যাতির মধ্যগগনে যখন সে প্রদীপ্ত, সেইসময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাওড়ার কাছে এক বিশাল ভূ-সম্পত্তির ওপর দিব্যজ্যোতি গড়ে তুলল। দিদিমার নামে ‘সুবর্ণলতা’ প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানের ভার দিল পরিচারিকা কল্পনা ও তার স্বামী সুখেনকে, যে কল্পনাকে একদিন সে। নির্মমভাবে নিজের প্রয়ােজনে ব্যবহার করেছে। গরিব মেয়েদের হাতের কাজ শিখিয়ে, তাদের শিল্পকর্ম দেশে-বিদেশে বিক্রি করে পথ চলা শুরু হল ‘সুবর্ণলতা'র। এই প্রতিষ্ঠানই দিব্যজ্যোতির। স্বপ্ন-সাধনা। সব সম্পর্ককে যে অবহেলায় উপেক্ষা করতে পেরেছে, সেই মানুষটা জড়িয়ে। গেল এই স্বপ্ন-সাধনার মর্মে মর্মে। কিন্তু সহসা সেরিব্রাল অ্যাটাকে জীবনপ্রেমী দিব্যজ্যোতি পঙ্গুত্বের আবর্তে ডুবে যায়। নিবে যেতে থাকে তার স্বপ্নসন্ধানী তারাদল। এক প্রাণান্তকর প্রয়াসে আবার জীবনের কাছে ফিরে আসতে চায় সে, পৃথাকে খোঁজে। কিন্তু তারপর? সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কলমে এক গভীর জীবনদর্পণ ‘আয়নামহল।
সুচিত্রা ভট্টাচার্য বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আত্মপ্রকাশ করা একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের বই সমূহ পাঠকদের প্রবলভাবে টানতে পেরেছে সমসাময়িক মধ্যবিত্ত শহুরে জীবনের টানাপোড়েন, পরিবর্তনশীল মূল্যবোধ আর নৈতিক অবক্ষয়কে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে। সেই সাথে নারীর জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, অনুভূতিগুলোও ছিলো সুচিত্রা ভট্টাচার্য এর বই সমগ্র’র আরেক উপজীব্য বিষয়। সুচিত্রা ভট্টাচার্য ১৯৫০ সালের ১০ই জানুয়ারি বিহারের ভাগলপুরে মামারবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। যদিও লেখিকার বাবার বাড়ি ছিলো মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে। কিন্তু লেখিকার স্কুল ও কলেজ জীবনের পুরোটাই কাটে কলকাতা শহরে। কলকাতার যোগমায়াদেবী কলেজ থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের সময়ই তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কর্মজীবনে প্রথমে বিভিন্নস্থানে চাকরি করে সরকারি চাকরিতে থিতু হন। কিন্তু ২০০৪ সালে পুরোপুরিভাবে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করার জন্য চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে দেন। প্রায় সাড়ে তিন দশকের দীর্ঘ সাহিত্যিক জীবনে সুচিত্রা ভট্টাচার্য অসংখ্য ছোটগল্প ও চব্বিশটি উপন্যাস রচনা করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে ‘মিতিন মাসি’র মতো নারী গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টি করে গিয়েছেন যা পাঠকদের কাছে আজও সমান জনপ্রিয়। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ছোটগল্পগুলো দিয়েই মূলত তিনি সাহিত্যে প্রবেশ করেন। কিন্তু তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো তাঁকে লেখক হিসেবে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাছের মানুষ, দহন, কাচের দেওয়াল, হেমন্তের পাখি, নীল ঘূর্ণি, অলীক সুখ, গভীর অসুখ, উড়ো মেঘ, ছেঁড়া তার, আলোছায়া, অন্য বসন্ত, পরবাস, পালাবার পথ নেই, আমি রাইকিশোরী ইত্যাদি। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস গল্প ‘দহন’ অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ ১৯৯৭ সালে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এছাড়াও লেখিকার উপন্যাস অবলম্বনে ‘ইচ্ছে’, ‘রামধনু’, ‘অলীক সুখ’, ‘অন্য বসন্ত’ এর মতো বেশ কিছু জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য এই বাঙালি নারী সাহিত্যিক কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী মেডেল (২০০৪), কথা পুরস্কার (১৯৯৭), তারাশংকর পুরস্কার (২০০০), দ্বিজেন্দ্রলাল পুরস্কার (২০০১), শরৎ পুরস্কার, ভারত নির্মাণ পুরস্কার, সাহিত্য সেতু পুরস্কার, শৈলজানন্দ স্মৃতি পুরস্কার এর মতো নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আজীবন তিনি কলকাতার ঢাকুরিয়ার বাড়িতে বসে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন। সেখানেই ২০১৫ সালের ১২ই মে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য।