“বইটি সম্পর্কে কিছু তথ্যঃ” টিনটিন একজন সাংবাদিক। যে যুগের প্রেক্ষাপটে এর্জে টিনটিনের এই পরিচয়টি তার একাধিক অভিযানের বর্ণনায় ব্যবহার করেছেন, সেই যুগটি ছিল রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুগ। এমনকি বাস্তবে চন্দ্রাভিযানের বহু আগেই তিনি তার কল্পনায় চাঁদে টিনটিনের অভিযানের গল্প শুনিয়েছেন। এর্জে টিনটিনের একটি পৃথক জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন। এই জগৎ ছিল আমাদের বাস্তব জগতের একটি সরলীকৃত অথচ সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। আর এই প্রতিচ্ছবি অঙ্কণে এর্জেকে সাহায্য করেছিল তার সুসংরক্ষিত ছবির একটি সংগ্রহ। টিনটিনের গল্পগুলি রহস্যের এক একটি ছকে-বাঁধা উপস্থাপনা। এই রহস্যের সমাধান করাও হয়েছে যুক্তিগ্রাহ্য পন্থায়। তবে তার সঙ্গে এর্জে মিশিয়ে দিয়েছেন তার নিজস্ব কৌতুকরসবোধ। তিনি এমন সব পার্শ্বচরিত্র সৃষ্টি করেছেন যাদের হাবভাবের গতিপ্রকৃতি আগে থেকে আন্দাজ করা গেলেও তাদের নিজস্ব চমৎকারিত্ব পাঠকে আকর্ষিত করে। ছকটি বেশ কোমল। হাস্যরসের পূর্বনিশ্চয়তা কতকটা পিনাটস বা দ্য থ্রি স্টুজেস সিরিজের চরিত্রগুলির মতো। কমিক স্ট্রিপের কলাকৌশল সম্পর্কে এর্জের ধারণা ছিল দক্ষ শিল্পীর মতোই। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য পান্না কোথায় গল্পে পদচারণার এক অপূর্ব ব্যঞ্জনাময় প্রয়োগ, যার মধ্যে তিনি এমন এক উদ্বেগের অভিপ্রকাশ ঘটান, যেখানে আদপেও উদ্বেগজনক কিছু ঘটেনি।
টিনটিনভক্তদের কাছে এই বেলজিয়ান কার্টুনিস্টের নামটি অত্যন্ত আপন বলে মনে হবে। টিনটিনসহ আরো অনেক কালজয়ী কমিকস চরিত্রের স্রষ্টা অ্যার্জে; তাঁর প্রকৃত নাম জর্জ রেমি। তবে ছদ্মনামেই তিনি অধিক পরিচিত। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন ১৯০৭ সালের ২২ মে। বিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় কমিকসের জগতে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম তাঁরই। জীবনে একবারও হার্জ এর বই পড়েনি, তখনকার সময়ে এমন শিশু-কিশোর ইউরোপে খুঁজে পাওয়া ভার ছিল। তবে অ্যার্জে এর কমিকস কোনো সময় বা স্থানের গণ্ডিতে বাঁধা পড়ে নেই, অভিযাত্রিক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। তেপান্তরের মাঠে সোনালী আভায় এখনও জ্বলজ্বল করে অ্যার্জে এর সৃষ্টি। টিনটিন ছাড়াও যে দুটো ধারাবাহিক কমিকের জন্য অ্যার্জে স্মরণীয় হয়ে আছেন, সেগুলো হলো ‘কুইক এবং ফ্লুপকে’ এবং ‘দ্য অ্যাডভেঞ্চারস অফ জো, জেট অ্যান্ড জোকো’। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া জর্জ রেমির কলমে জন্ম নেয় দুঃসাহসী টিনটিন চরিত্রটি। টিনটিন নিয়ে লেখা অ্যার্জে এর বই সমূহ থেকে একসময় নির্মাণ করা হয় বহু নাটক-সিনেমাও। টিনটিন অনুবাদ করা হয়েছে পঞ্চাশোর্ধ্ব ভাষায়। টিনটিন এর বাংলা বই আজও তাই জড়িয়ে আছে অনেক বাংলাভাষীর স্কুলপালানো সময় কিংবা টিফিনের জমানো টাকার স্মৃতিতে। ১৯২১ সালে টিনটিনের পথচলা শুরু হয় ‘সোভিয়েত দেশে টিনটিন’ দিয়ে, এবং অ্যার্জের মৃত্যুর আগপর্যন্ত, অর্থাৎ ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তার অভিযাত্রা অব্যাহত থাকে। অনেক পাঠকই টিনটিনের সাথে বড় হয়েছেন বলা যায়। ১৯৮৩ সালের ৩রা মার্চ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে টিনটিনের মতোই কোনো এক নাম না জানা অভিযানে বেরিয়ে পড়েন অ্যার্জে।