দেবতাকে প্রিয় এবং প্রিয়কে দেবতা করে তােলার প্রয়াস বৈষ্ণব কবিদের রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-বিষয়ে তাঁরাই অগ্রপথিক কিনা তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী তাঁর এই গ্রন্থে অতি মনােগ্রাহী এক আলােচনার মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে, এই প্রবণতার পিছনে রয়েছে সুদীর্ঘ এক পরম্পরা। বেদ-পুরাণ এবং কবি-মহাকবিদের নানান কাব্যকীর্তির মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে দেবতার মানবায়নের এই পরম্পরা। শুধু দেবতারাই বা কেন, অসুর, রাক্ষস, মহাপুরুষ সকলেই অন্তর্ভুক্ত এই পরম্পরায়। মানুষের নানা অবস্থার কথা বােঝাতে গিয়ে আমরা যে ব্যবহার করি ‘গগাবর-গণেশ’, ‘হাঁদা গঙ্গারাম, ‘কলির কেষ্ট’ বা ‘ন্যাকা চৈতন্য জাতীয় বিবিধ বিশেষণ, উৎস খুঁজলে দেখা যাবে যে, এ-সবও সেই পরম্পরারই এক অঙ্গ। সংস্কৃত শাস্ত্র, সাহিত্য ও লৌকিক প্রবাদের মধ্যে এই পরম্পরা কীভাবে গড়ে উঠেছে এবং কীভাবে ঘটেছে তার বিস্তার—তাই নিয়েই এই সুদীর্ঘ ও সারবান আলােচনা গ্রন্থ। দার্শনিক দিক থেকেও লেখকের প্রতিপাদ্যের এক পরম প্রতিষ্ঠা এখানে। কীভাবে প্রিয় দেবতাকে সখা ও পিতার মতাে পেয়েছি আমরা, নিয়ন্তার দূরত্ব ঘুচিয়ে প্রিয়ত্বের সীমারেখার বিস্তৃততর গণ্ডিতে কীভাবে ধরা পড়েছেন দেবতারা—বিশেষত বৈদিকোত্তর যুগের দেবতারা, কীভাবে তাদের দেবত্বকে ঘুলিয়ে দিয়েছি আমরা, তিরস্কৃত করেছি বিপরীত কার্যকলাপের জন্য, চরম রঙ্গ-রসিকতার মধ্য দিয়ে দেখিয়েছি তাদের স্থলন-পতন-ত্রুটিগুলিকে, আবার কীভাবে স্থাপন করেছি যথাযােগ্য পূজ্য আসনে—সমূহ সংস্কৃত শাস্ত্র ও সাহিত্য মন্থন করে, লােকায়ত প্রবাদের ভাণ্ডার হাতড়ে তারই চমকপ্রদ বিবরণ এই বইতে শুনিয়েছেন নৃসিংহপ্রসাদ। তাঁর বলার ভঙ্গিটি আদ্যন্ত অন্তরঙ্গ, শাস্ত্র ও সাহিত্যের গল্প ও ব্যাখ্যা শশানান অতি সরস ও স্বাদু ভাষায়, কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণ ও প্রতিপাদ্যের ক্ষেত্রে কোনও লঘুতাকে প্রশ্রয় দেননি নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী।