"ছবির চশমা" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: আজ থেকে পাঁচ-ছয় কি সাত দশক আগের বিখ্যাত যেসব মাসিকপত্র, তার প্রত্যেকটির অন্যতম আকর্ষণ ছিল শিল্পী হেমেন্দ্রনাথ মজুমদারের আঁকা ছবি। সেসব ছবির মধ্যে আবার সবথেকে জনপ্রিয় ছিল হেমেন্দ্রনাথের তেলরঙে আঁকা “সিক্তবসনা সুন্দরী’ সিরিজ। ক্যামেরার তীক্ষ্ণতম লেন্সকেও হার মানায়, এমনই জীবন্ত সেই সিরিজের একেকটি ছবি । সমকালে বিপুলভাবে বন্দিত এই শিল্পী যে উত্তরকালের জন্যও রচনা করেছিলেন চিত্রশিল্প ও চিত্রশিক্ষা বিষয়ে সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি একথা কিন্তু অনেকেই জানতেন না। তার কারণ, শেষাবধি গ্রন্থটি মুদ্রিত হয়নি। তবু হেমেন্দ্রনাথ সেবইয়ের নাম পর্যন্ত রেখেছিলেন—ছবির চশমা—এবং উৎসর্গ করেছিলেন স্ত্রীকে। শােভন বসুর সহায়তায় সেই অপ্রকাশিত গ্রন্থটির জীর্ণ, ছিন্ন ও ধূসর পাণ্ডুলিপি থেকে অতি যত্নে-নিষ্ঠায়-পরিশ্রমে প্রবন্ধগুলির উজ্জ্বল উদ্ধার ঘটালেন এ-যুগের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও অভিজ্ঞ সম্পাদক ডক্টর উজ্জ্বলকুমার মজুমদার। বাংলা ভাষায় হেমেন্দ্রনাথের এই অমুদ্রিত প্রবন্ধগ্রন্থের প্রকাশ। নিঃসন্দেহে বিরল ও গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। অপ্রকাশিত এই প্রবন্ধাবলি ছবি আঁকা এবং ছবি সম্পর্কে শিল্পী হেমেন্দ্রনাথের দীর্ঘদিনের চিন্তার ফসল। এসব প্রবন্ধে এদেশীয় চিত্রশিল্পীদের অবহেলার জন্য যেমন বেদনার উচ্চারণ, তেমনই রয়েছে চিত্রসম্পদের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের প্রতি অবহেলার জন্য আক্ষেপ। চিত্রাঙ্কন-ধারাকে সঠিক চিহ্নিতকরণে অনীহা, চিত্রশিক্ষার তথা স্বাধীন শিল্পচর্চার পরিবেশের অভাব, তাত্ত্বিক সৌন্দর্য ফোটানাের নামে ভারতীয় চিত্রকরদের বিকৃতি, একদিকে বিদেশী শিল্পীদের অযথা নিন্দা অথচ অন্যদিকে তাদেরই প্রশংসা অর্জনের জন্য। লােভ—এমন নানা ব্যাপার কীভাবে আমাদের শিল্পজগতের ক্ষতি করছে, দ্বিধাহীন ভাষায় সেসব কথা জানিয়েছেন হেমেন্দ্রনাথ। চিত্রকলার নবজাগরণের যুগে ঐতিহ্য ও বিদেশী প্রভাবের অনিবার্য যে-টানাপােড়েন, তার মধ্যেও হেমেন্দ্রনাথ ছিলেন খােলামনের আত্মস্থ এক শিল্পী। অকারণ বিদেশী-বিরাগে তাঁর সায় ছিল না, শিল্পের প্রয়ােজনে বিদেশী উপকরণ ব্যবহার করাকেও অসঙ্গত মনে করেননি তিনি। এই প্রবন্ধাবলি শুধু তাঁর জোরালাে ব্যক্তিত্ব ও স্পষ্ট মতামতকেই নয়, তাঁর নিজস্ব সাধনা ও সাফল্যের মর্মকথাকেও ফুটিয়ে তুলেছে।
জন্ম : ১৯৩৬ সাল। ভবানীপুর, দক্ষিন কলকাতা। শিক্ষা : সেন্ট লরেন্স স্কুল, কলকাতা, সেন্ট জনস সি.এম.এস.স্কুল, কৃষ্ণনগর। কৃষ্ণনগর গভঃ কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ। কর্মজীবন : উত্তরপাড়া প্যারীমোহন কলেজ থেকে ১৯৫৮ সালে। এরপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যাভবনে কাটে ছ’বছর। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বত্রিশ বছর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপনা করেছেন। একবছর বিশ্বভারতীর রেজিস্ট্রার ছিলেন এবং এশিয়াটিক সোসাইটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অধ্যাপক হিসেবে গবেষণা-পরিচালনা করেন। বেশ কয়েকবার রবীন্দ্র সাহিত্য সম্বন্ধে বক্তৃতার জন্যে আমেরিকায় নিমন্ত্রিত হ’য়ে গেছেন। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং ফেলো ও নিখিল ভারতবঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের (দক্ষিণ কলকাতা শাখা) সভাপতি ছিলেন। পুরস্কার : ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৯), তারাশঙ্কর স্মৃতি পদক (১৯৯০), নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার (২০০২)। টেগোর রিসার্চ ইন্সটিটিউট থেকে রবীন্দ্র-তত্ত্বাচার্য উপাধি লাভ (২০০৫)। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : বাংলা কাব্যে পাশ্চাত্য প্ৰভাব, সাহিত্য সমালোচনার রূপ-রীতি, করতলে নীলকান্তমণি, রবীন্দ্রনাথ : সৃষ্টির উজ্জ্বল স্রোতে, গল্প পাঠকের ডায়ারি ইত্যাদি।