"প্রথম আলো - ২" বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে নেয়াঃ মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি ও বিশালতা নিয়ে দু'খণ্ডে শেষ হল এই বর্ণাঢ্য এবং বেগবান উপন্যাস। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত ও প্রেক্ষাপটে রচিত ‘প্রথম আলাে’র সময়কাল আঠারােশাে তিরাশি থেকে উনিশ শাে সাত-এক শতাব্দীর শেষ ও অন্য শতাব্দীর শুরু। এ সেই সময়, যখন হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে কিছু মানুষ আবিস্কার করছে দেশ নামের এক ভাবসত্তাকে। শরীরে অনুভব করছে পরাধীনতার জ্বালা। ব্যক্তিগত মমর্যাতনা, ভালবাসার অপূর্ণতাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে জাতিগত অধঃপতনের গ্লানি। দু-পর্বে বিন্যস্ত এই মহান উপন্যাসের কাহিনীর শুরু এক রাজ-অন্তঃপুরে। রাজ্যের নাম-ত্রিপুরা। সেই পার্বত্য ত্রিপুরা-রাজ্য থেকে ক্রমশ এই কাহিনী বিস্তৃত হয়েছে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতায়, তারপর সমগ্র ভারতে। এই উপন্যাসের সময়সীমায় জাতীয়তাবােধ ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষই প্রধান ঘটনা। ফলে, তৎকালীন দেশের অবস্থা বােঝাবার জন্যেই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ধর্ম-আন্দোলন, মহেন্দ্রলাল সরকার প্রমুখের বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাধারা, পেশাদারি রঙ্গমঞ্চ ও তার প্রবাদপ্রতিম অভিনেত্রীদের ভূমিকা, রবীন্দ্রনাথের কবিজীবনের নানা রূপান্তর, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে নবীনদের মতবিরােধ, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূচনা, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভেদ-রেখা সৃষ্টি ইত্যাদি অনেক প্রসঙ্গ এসেছে অনুপুঙ্খভাবে। এসেছে অসংখ্য জীবন্ত চরিত্র। সমকালের বহু খ্যাতিমান ব্যক্তি। সেই সঙ্গে অনেক দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সাধারণ মানুষ। আবার সবাইকে ছাপিয়ে, এই উপন্যাসের মূল নায়ক-সময়। এপিকধর্মী এই উপন্যাস নিছক ঐতিহাসিক উপন্যাস নয়, এই পরিচয়ের বাইরে অন্য কিছু। বলা যায়, আমাদের দেশের অনতিঅতীতের পুনর্দর্শন ও পুনর্বিচারে আয়ােজনে পূর্ণ প্রথম উপন্যাস-প্রথম আলাে।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।