ভূমিকা কতকগুলি ঐতিহাসিক ও চাক্ষুষ সত্য ঘটনার হাসি-কান্না লইয়া ‘অবরোধ বাসিনী’ রচিত হইল। পাঠক-পাঠিকাগণ অধিকাংশ স্থলে হাসিবেন ,সন্দেহ নাই, কিন্তু কোনো কোন স্থলে তাঁহাদের মন সমবেদনার উদ্রেক হইবে এবং আমার বিশ্বাস তাঁহারা ‘তাহেরা’ মরহুমার অকাল মৃত্যুতে দুই বিন্দু অশ্রু বিসর্জন না করিয়া থাকিতে পারিবেন না। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল-ইনসপেক্টর পরম ভক্তিভাজন জ্ঞান-বৃদ্ধ মৌলবি আবদুল করিম সাহেব বি. এ., এম. এল. সি. দয়া করিয়া ‘অবরোধ বাসিনী’র ভূমিকা লিখিয়া দিয়াছেন। সেজন্য তাঁহাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি; উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর জীবনের ২৫ বৎসর ধরিয়া সমাজ-সেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইয়াতেছি। হজরত রাবিয়া বসরী বলিয়াছেন , ‘ইয়া আল্লাহ! যদি আমি দোজখের ভয়ে এবাদত করি, তবে আমাকে দোজখে নিক্ষেপ কর ; আর যদি বেহেশতের আশায় এবাদত করি তবে আমার জন্য বেহেশত হা্রাম হউক। “ আল্লাহর ফজলে সমাজ সেবা সম্বন্ধে আমিও এখনও ঐরূপ বলিতে সাহস করি। আমারতো প্রত্যেকটি লোম গুনাহগার; সুতরাং পুস্তকের দোষ-ত্রুটির জন্য এবার পাঠক-পাঠিকাদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিলাম না। বিনীতা-- গ্রন্থকর্ত্রী
(সাহিত্যসেবী মহলে তিনি বেগম রোকেয়া নামেই সমধিক পরিচিত; ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ - ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২) হলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তাঁকে বাঙালি নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে গণ্য করা হয়। তার প্রকৃত নাম "রোকেয়া খাতুন" এবং বৈবাহিকসূত্রে নাম "বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন"। রোকেয়া জন্মগ্রহণ করেন ৯ ডিসেম্বর ১৮৮০ সালে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার অর্ন্তগত পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। তিনি একজন অসাধারণ নারী।১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে রোকেয়ার বিয়ে হয় ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে। বিয়ের পর তিনি "বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন" নামে পরিচিত হন। তাঁর স্বামী মুক্তমনের মানুষ ছিলেন, রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন এবং একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন। রোকেয়া সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্প লিখে সাহিত্যজগতে তার অবদান রাখা শুরু হয়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন। তাঁর কবর উত্তর কলকাতার সোদপুরে অবস্থিত যা পরবর্তীকালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক অমলেন্দু দে আবিষ্কার করেন । বাংলাদেশের ৭ম বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' ৮ অক্টোবর ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে 'নারী জাগরণের অগ্রদূত' হিসেবে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়টির বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ করেন । উল্লেখ্য , নারীর নামে বাংলাদেশে প্রথম কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এটি।ছাড়াও, মহিয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য "রোকেয়া হল" নামকরণ করা হয়। রোকেয়ার তাঁর নারীবাদী চিন্তার প্রকাশ ঘটিয়েছেন মতিচূর প্রবন্ধসংগ্রহের প্রথম (১৯০৪) ও দ্বিতীয় খণ্ডে (১৯২২)। সুলতানার স্বপ্ন (১৯০৫), পদ্মরাগ (১৯২৪), অবরোধবাসিনী (১৯৩১) ইত্যাদি তাঁর সৃজনশীল রচনা। তাঁর সুলতানার স্বপ্নকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়।