ফরওয়ার্ড মার্চ’—বিজয়ী বিধাতার হৃদয়হীন সেনাপতি পরাজিত বন্দিকে হুকুম দিলেন। প্রাণ না চাইলেও, আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত মনটাকে ক্লান্ত দেহের ঠেলা-গাড়িতে চড়িয়ে আবার যাত্রা শুরু করতে হলো। Onward! Don't look back—সামনে সামনে। পিছনে তাকিও না।' আমার পিছনে এবং সামনে কেবল পথ। যেন রাত্রের অন্ধকারে ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটের অচেনা সরাইখানায় আশ্রয় পেয়েছিলাম। এখন ভোরের আলোয় পথকে আবার ঘর করেছি। হাইকোর্টের বাবুরা এসেছিলেন। চোখের জল ফেলেছিলেন। ছোকাদা বলেছিলেন, “আহা, এই বয়সে স্বামী হারালি ! একেবারে কাঁচা বয়েস।” আমি কিন্তু কাঁদিনি। একটুও কাঁদিনি। বজ্রাঘাতে আমার চোখের সব জল যেন ধোঁয়া হয়ে গিয়েছিল। ছোকাদা কাছে ডেকে বসিয়েছিলেন। শিখের দোকান থেকে চা আনিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “বুঝি ভাই, সব বুঝি। কিন্তু এই পোড়া পেটটা যে কিছুই বুঝতে চায় না। সামান্য যা হয় কিছু মুখে দে, শরীরে বল পাবি।” ওল্ড পোস্ট অফিস স্ট্রিটে সেই আমার শেষ চা-খাওয়া। ছোকাদা অবশ্য বলেছিলেন, “ভাবিস না, এই পাড়াতেই কিছু একটা জুটে যাবে। তোর মতো বাবুকে কোন সায়েবের না রাখতে ইচ্ছে হয় বল? তবে কিনা এক স্ত্রী থাকতে, অন্য কাউকে নেওয়া। সবারই তো বাবু রয়েছে।” জোর করে কথা বলা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। কিন্তু সেদিন চুপ করে থাকতে পারিনি। জোর করেই বলেছিলাম, “ছোকাদা, আমি পারব না। চাকরি পেলেও এ-পাড়ায় আর থাকতে পারব না । ” ছোকাদা, অর্জুনদা, হারুদা সবাই সেদিন আমার দুঃখে অভিভূত হয়েছিলেন। বিষণ্ণ ছোকাদা বলেছিলেন, “আমাদের দ্বারা তো হল না। যদি কেউ পারে তো তুই পারবি। পালিয়ে যা—আমরা জানব এই সর্বনাশা গোলকধাঁধা থেকে অন্তত একজনও বেরিয়ে যেতে পেরেছে।” ওঁদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, আমিও টিফিন কৌটো সমেত কাপড়ের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম। পশ্চিম আকাশের বিষণ্ণ সূর্য সেদিন আমার চোখের সামনেই অস্ত গিয়েছিল।
শংকর একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক। তাঁর আসল নাম মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল চৌরঙ্গী, সীমাবদ্ধ এবং জন অরণ্য। এই তিনটি বই নিয়ে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। ২০১৬ সালে তিনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি.লিট সম্মানে ভূষিত হন।