‘নজরুল গীতির স্বরলিপি গ্রন্থ ( হিন্দোল ২য় খন্ড)’ আমার কথা (প্রথম সংস্করণ): কোন নিয়মের সাহায্যে একটি বিষয়ের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষণ বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে যদি একটি সুসংবদ্ধ রীতি-পদ্ধতি গড়ে ওঠে এবং সেই বিষয় সম্পর্কিত যাবতীয় সমস্যার সমাধান ঘটায় এবং সেই নিয়মকে যদি তখন বিজ্ঞান সম্মত বলা যায়, তবে নিঃসন্দেহে আকারমাত্রিক স্বরলিপি একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি। বহু বছরের পরীক্ষানিরীক্ষার পর বাংলা গানের জগতে আকারমাত্রিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ইতিপূর্বে দণ্ডমাত্রিক পদ্ধতি দ্বারা যাবতীয় গানের স্বরলিপি করা হতো এবং এই পদ্ধতির সাহায্যেই ১২৭৫ সালে ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী তার সর্বপ্রথম বাংলা স্বরলিপিসহ তথ্যপূর্ণ পুস্তক ‘সঙ্গীত সার’ বের করেন। এ পুস্তক প্রকাশের পর স্বরলিপি পদ্ধতির কয়েকটি ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সঙ্গীত মহলে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়। ১২৮৬ সালের অগ্রহায়ণ মাসে রাজা শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের যত্নে ও পরিচালনায় সঙ্গীত সার’ দ্বিতীয়বারের মতো আত্মপ্রকাশ করে। এবারেও আগের মত দণ্ডমাত্রিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। এরপর কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় ও রামপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়ের স্বরলিপি পুস্তকসমূহ দণ্ডমাত্রিকে প্রকাশিত হবার পর বাংলা গানের ক্ষেত্রে একটি বিকল্প স্বরলিপি-পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হয় পরবর্তী সময়ে ভারত সঙ্গীত সমাজ’ সর্বপ্রথম আকারমাত্রিক পদ্ধতির ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন এবং দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখ আরো অনেকের তীব্র সমালোচনার সম্মুখীন হন। এর ফলে আকারমাত্রিক পদ্ধতি ক্রমশঃ নিখুঁত হয়ে উঠতে থাকে এবং একে সর্বাঙ্গীন সুন্দর রূপদান করেন জ্যোতিরিন্দ্র নাথ ঠাকুর। ১৮৯৭ সালে ডোয়াকিনের দোকান থেকে স্বরলিপি-গীতিমালা প্রকাশিত হয় এতে ছিল আকারমাত্রিক স্বরলিপির ব্যাখ্যা। সঙ্গীতবিষয়ক মাসিক পত্রিকা বীণা-বাদিনী’ ও ১৯০১ সনে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত প্রকাশিকা'র সাহায্যে তখন রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচারকার্য চলতে থাকে। এইভাবে ক্রমশঃ আকারমাত্রিক পদ্ধতি সুপরিচিত হয়ে ওঠে এবং জনসমাজে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য যে, আকারমাত্রিকের সর্বমোট ২৭টি নিয়ম বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ব্যবহার করা হয় না এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও তা করেননি। এ কথা বলার অর্থ এই যে, যত সূক্ষ্ম অথবা জটিল সুরাংশই হোক না কেন, আকারমাত্রিকের সাহায্যে তা প্রকাশ করা চলে। কাজেই একে বিজ্ঞানসম্মত বলবো এবং এই কারণেই নজরুল ও তাঁর ভক্ত অনুসারীদের মতো আমিও তাই আকারমাত্রিককেই অনুসরণ করেছি। আমার ক্ষুদ্র ধারণায় স্বরলিপিই হচ্ছে একমাত্র পথ, যার দ্বারা গানকে চিরস্থায়ী করে রাখা যায়। কবিগুরুর প্রতিটি গানকে স্বরলিপিতে সযত্নে বেঁধে রাখা হয়েছে; কণ্ঠের বিভিন্নতায় সুরের হয়তো তারতম্য ঘটেছে কিন্তু মূল সুরের কাঠামো থেকে গান কখনো বিচ্যুত হয়নি। অথচ, বাংলা দেশের সর্বাধিক সংখ্যক গানের রচয়িতা আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের গানগুলো আজ বিস্তৃতির অতলে তলিয়ে যাবার পথে। ‘হিন্দোল’ ১ম খণ্ডে অনেকগুলো অপ্রচলিত গান দেয়া হয়েছে। ২য় খণ্ডেও বেশ কিছু সংখ্যক অপ্রচলিত গান দেয়া হলো। একটি গজল ও দুটো গানের বেলায় মাসিক ভারতবর্ষে প্রকাশিত স্বরলিপির আংশিক রদবদল আমাকে করতে হয়েছে রেকর্ডের সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখি কোন কোন গানের স্বরলিপি তুলতে গেলে স্বরলিপি দু একটি শব্দের সঙ্গে ওপরে দেয়া গানের কথার কিছুটা গরমিল দেখা যাবে। দুটো শব্দই যে ব্যবহার করা যাবে, তা বোঝানোর জন্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই এরূপ করা হয়েছে। আমার স্বরলিপিগুলো কেমন হয়েছে অথবা আদৌ হয়েছে কি না সে বিচারের ভার সঙ্গীতমনা ভাই বোনদের ওপরেই ছেড়ে দিচ্ছি। সূর্যের আলো সমভাবে বিভিন্ন বস্তুর ওপর পতিত হলেও পদার্থের গুণেই তা ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রতিফলিত হয়। আমিও নজরুল-গীতির সুরগুলোকে যেভাবে গ্রহণ করতে পেরেছি, সেভাবেই তা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি মাত্র। মফিজুল ইসলাম।
প্রকৃতি, পরিবেশ ও মানব প্রেমিক মফিজুল ইসলামের জন্ম ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি, শরীয়তপুর (তৎকালীন ফরিদপুর) জেলার পালং থানার সুবেদারকান্দি গ্রামে। বর্তমান আবাস; কবিকুঞ্জ, স্বর্ণঘােষ, শরীয়তপুর পৌরসভা। পিতা : মেঘাই সরদার, মাতা: হাফিজা খাতুন ছুটু বিবি। তিনি একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা এবং কবি, আবৃত্তি শিল্পী, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক। এলাকায় ‘কবিভাই’ হিসেবে পরিচিত। পরিবেশ ও জীবনের কল্যাণে করণীয় এবং শিক্ষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থী ছেলেমেয়েদের তিনি উৎসাহিত করেন। শরীয়তপুর সাহিত্য একাডেমী ও ‘প্রতিভাস আবৃত্তি সংসদ, শরীয়তপুর জেলা শাখার সভাপতি এবং নজরুল একাডেমী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট শরীয়তপুর জেলা শাখার সাধারণ। সম্পাদক। প্রকাশিত বই: ‘ছবি’, ‘হৃদয় অতল তলে’, ‘বিক্ষুব্ধ সংলাপ', এই এখানেই’, ‘অন্ধকারে হাজার তারা’, ‘বেদনার নীল চিঠি’, ‘আজকের অঙ্গীকার’, ‘প্রতীক’, ‘বিষাদ বিজয়ে’, ‘বাঙালি’ প্রভৃতি। পরিবেশ ও জীবন’ নামে প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক (রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ২০১১)। লােকসংস্কৃতির উপরকণ সংগ্রহ তাঁর শখ।