বাংলা কবিতায় শামসুর রাহমান (১৯২৯-) একটি প্রবাদতুল্য নাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও জীবনানন্দ দাশের পর বাংলা ভাষাভাষীদের মহান কবি হিসেবে তাঁর নামই আজ সর্বাধিক স্বীকৃত। পৃথিবীর বেশির ভাগ বড় কবিই ছােটদের জন্য। লিখেছেন। শামসুর রাহমানও কার্পণ্য করেননি। জীবনভরই তিনি শিশু-কিশােরদের দাবির মুখে কলম ধরেছেন। এলাটিং বেলাটিং, ধান ভানলে কুঁড়াে দেবাে, গােলাপ ফোটে খুকির হাতে, রংধনুর সাঁকো, লাল ফুলকির ছড়া, নয়নার জন্য হীরার পাখির গান ইত্যাদি ছড়া ও কিশাের কবিতার বইই তার উজ্জ্বল প্রমাণ। শ্রেষ্ঠ কবিতার পাশাপাশি কবি ছড়াসমগ্রও এখন পাঠকদের হাতের নাগালে। অতএব বঞ্চিত করেননি কবি শিশু-কিশােরদেরও। প্রত্যেক বড় কবির মধ্যেই থাকে অনন্ত শৈশব। শৈশবই কবিদের পরম আশ্রয় । শৈশবে যে কবি বিস্ময়-ভরা চোখে জগৎকে দেখেছেন, পরিণত বয়সেও চোখ বুজে তিনি ভালবাসার বিশাল মায়ারাজ্য রচনা করতে জানেন। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয় শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর নামের বইটিকেও। অফুরন্ত শৈশবকে নিয়ে লেখা স্মৃতির শহর শুধু শিশু-কিশােরদেরই নয়, বয়সীদের শিশু-মনকেও জাগিয়ে তােলে। পুরানাে ঢাকার বায়ান্নো বাজার আর তেপ্পান্নো গলিকে সঙ্গে নিয়ে এই বই যেন মিছিল করে ছুটে আসে প্রতিদিনের বন্দিজীবন থেকে পাঠককে মুক্তি দিতে। স্মৃতির শহরের বাছুই আজ বাংলা ভাষার প্রবাদপ্রতিম কবি শামসুর রাহমান। মাথার সব চুল শরতের কাশফুলের মতাে শাদা হয়ে গেলেও এই কবির মনে বাস করে এক চির-কিশাের। সেই কিশাের এখনও রূপালি ঘুঙুর-পরা অপরূপ নদীর ডাকে অসংখ্য নয়না-দীপিতাকে নিয়ে ছুটে যায় হাজার পাড়াতলীতে। মাঠের শালিক পাখিকেই সে চিরকালের রৌদ্র-ছায়ার মালিক বলে জানে। চির সেই কিশাের চিরদামালও বটে। তাই রক্তঝরা বায়ান্নো থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত কিছুই বাদ পড়ে না তার ভাবনায়। বাঙালির ইতিহাসকে যারা বিকৃত করতে চায়, সােচ্চার কলমে রুখে দাঁড়ায় সে তাদের বিরুদ্ধেও। এমনই এক কাশশাদা চুলের চির-কিশাের কবি শামসুর রাহমান। ছােট-বড় সবারই খুব কাছের মানুষ। মানুষ ও প্রকৃতিকে তিনি ভালবাসেন। পাঠককে তিনি ভালবাসতে শেখান। ভালবাসার আলােয় দূর করতে চান পৃথিবীর যাবতীয় অন্ধকার ।
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।