"চিহ্ন" বইয়ের ভূমিকার অংশ থেকে নেয়া: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের চতুর্দশতম উপন্যাস এই অত্যন্ত আধুনিক উপন্যাসটি পড়ে মনে হয় না এটি ১৯৪৭ সালে রচিত। বরং মনে হয় এটি সাম্প্রতিক কালের কোন স্বাধীকারের লড়াই সম্পর্কিত উপন্যাস। ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সাল ছিল পাক-ভারত উপমহাদেশের সাংঘর্ষিক, উন্মাদনায় ও আত্মপরিচয় আবিষ্কারের বছর। সদ্য সদ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে। বিশ্বরাজনীতির নতুন মেরুকরণ হয়েছে। তার ঢেউ এসেছে লেগেছে পরাধীন ভারতবর্ষেও। মানুষের পুঞ্জীভূত বেদনা, অপমানের গস্তানি আর পরাধীনতার যন্ত্রণাজর্জর অভিব্যক্তি যেন চারদিক থেকে আছড়ে পড়তে চাইছে, সবকিছু ভাসিয়ে নিতে চাইছে। রশিদ আলি দিবস (টীকা) উপলঙ্গে ইংরেজ পুলিশের নৃশংসতার প্রত্যঙ্গ ঘটনার উপর ভিত্তি করে উপন্যাসটি রচিত হয়। রাজনৈতিক সচেতনতার ছোঁয়া থেকে প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষটিও যে বাদ পরেনি তার যেন জীবন্ত্ম দলিল এই উপন্যাস। উপন্যাসের ব্যাপ্তি দেখে বিস্মিত হতে হয়। যেন ঔপন্যাসিক স্বাধীনতার এক মহাকাব্যিক দলিল রচনা করেছেন। এ দলিলে কোন সনতারিখ নেই, কোন বিশেষ জায়গারও গুরম্নত্ব দেয়া হয়নি। কিন্তু এ দলিলে রয়েছে আর্তমানবতার ঝাকুনি খেয়ে সামনে চলার গল্প । এক শুভ পরির্তনের জটিল গ্রন্থালেখ্য।
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।