৭০ বছর আগে ‘মহাস্থবির জাতক'-এর প্রথম খণ্ডের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লেখক অকপটে লিখতে পেরেছেন, ‘মানুষের জীবনের কাহিনীই সব-চাইতে বিচিত্র উপন্যাস'—এমন দুঃসাহসী উক্তির পর এই গ্রন্থের গোত্রনির্ণয় আদৌ সুসাধ্য বা নিরাপদ নয়। তবে, কিছুমাত্র ঝুঁকি না নিয়েও যে-কথাটি নির্ভয়ে বলে ফেলা যায়, তা হলো, বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত গ্রন্থরাজির ঝাপিতে ‘মহাস্থবির জাতক’ একটি উজ্জ্বল রত্ন। প্রচলিত প্রথায় স্মৃতিকথাকে কেউ বলেন, 'এ শুধু চিত্রশালা', কেউ বলেন, এর পরিধি আরও প্রসারিত, আরও গুরুত্বপূর্ণ—এ হলো ইতিহাস। বিতর্কে প্রবেশ না করে আমাদের সরল স্বীকারোক্তি : মহাস্থবির জাতক' এ-সবেরই ত্রিবেণী-সংযম। এ যেন স্মৃতির সুতোয় গাঁথা চলমান মানুষের উপন্যাসোপম ইতিহাস। এই গ্রন্থের কুশীলবগণ জীবনের রঙ্গমঞ্চে যে-যার ভূমিকায় অভিনয় করে যবনিকার অন্তরালে অদৃশ্য হয়েছেন দর্শকের মনে হাসি-কান্না-আনন্দ-বেদনা-করুণা-নিষ্ঠুরতা-শঠতা- উদারতা-নীচতা-উচ্চাদর্শের বর্ণময় আলেখা এঁকে রেখে। আর তাই নিয়েই দর্শকের অগোচরে রূপলাভ করেছে বিশ শতকের একটা সময়ের অনবদ্য চিত্ররূপময় কথামালা। চারপর্বের একত্রিত এই স্মৃতিকথা-ইতিহাস উপন্যাসের অখণ্ড সংস্করণের বিভিন্ন ভূমিকায় রয়েছেন বাল্যসখী নন্দা, স্কুলের বন্ধু মাতৃহীন শচীন, কুমারী মাতা অলকা বা লোকা, উন্মাদিনী সহপাঠিনী সুবর্ণ, সুলতা বা লতু, গোষ্ঠদিদি, পাগলা সন্ন্যাসী, রাজকুমারী, দিদিমণি, পিয়ারা সাহেব, নবাব সাহেব, অমরনাথ সর্বোপরি লেখকের আদর্শবাদী দুর্বাসা-স্বভাব পিতৃদেব। এমন অসংখ্য মণিমুক্তার বিভা বর্ণনা করে বোঝানো যাবে না। গ্রন্থপাঠেই যা স্বমহিমায় পাঠকের স্মৃতিমঞ্জুষায় চিরস্থায়ী আসন পাবে। কথাতেই তো আছে : একই ক্ষেত্রে শালিধান ও শ্যামাধান জন্মে, উভয়েরই দল, কাণ্ড প্রভৃতি একরূপ। কিন্তু ফলের দ্বারাই উভয়ের প্রভেদ জানতে পারা যায়। বইটির প্রথম প্রকাশের ছয় দশক পরেও সমান জনপ্রিয়তার নিরিখে উপরের বক্তব্যকে অত্যুক্তি মনে করার কোনো অবকাশ আছে বলে আমাদের মনে হয় না।