বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিকতার সূত্রপাত নির্দেশ করা হয় ভারতচন্দ্রের তিরােধানের (১৭৬০) পরবর্তী কাল হতে। আর সে আধুনিকতার সীমা-সরহদ্দ আজও সুস্পষ্ট নয়। মধুসূদনকে রবীন্দ্রনাথ একদা ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্যের দ্বার উন্মােচনকারী’বলেছিলেন। অথচ ঐ প্রায় একই সময়ে, এবং তার পূর্বাবধিও ‘আধুনিক বাংলা কবিতার উৎস নির্দেশিত হচ্ছিল বীন্দ্র-উত্তর’কবিগােষ্ঠীর রচনাতে । একেবারে হালের বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সাজবদল হয়ে চলেছে প্রায় নিরন্তর । এই অস্বচ্ছ পরিমণ্ডলে ইতিহাসের সন্ধানী আলাের তলায় সাহিত্যে আধুনিকতার চরিত্রটিকে পরিস্ফুট করে দেখার প্রয়ােজন মৌলিক । আর আধুনিকতা আসলে একটা মর্জি-রবীন্দ্রনাথই বলেছিলেন, এক বিশিষ্ট মনােভঙ্গির ফসল! বিশেষ ধরনের কাল-চেতনার দ্বারা তার চরিত্র নিয়মিত; অথচ কালের নিরিখেই তার একমাত্র পরিমাপ নয়। তেমনটি হলে আজ যা আধুনিক, কালই তা অনাধুনিক হয়ে পড়তে বাধা। নেই। এরকম গােল বাঁধে সাম্প্রতিকতার সঙ্গে আধুনিকতার ধারণাটিকে জট পাকিয়ে দিলেই। প্রথমটি কালবাচক অভিধা, দ্বিতীয়টি আগেই বলেছি সুনির্দিষ্ট মনােভঙ্গির দ্যোতক। আর সময়ের সীমানা পেরিয়ে পেরিয়েই মনের তরঙ্গ নূতন বাঁকে মােড় ফিরতে পারে। সেই অর্থেই আদিযুগের জীবনগ্রন্থি ভেদ করে যেমন মধ্যযুগীয় মানসিকতায় উত্তরণ, তেমনি মধ্যযুগীয় মনােভঙ্গির পরিণামসূত্রেই আধুনিক মেজাজের উদ্ভব এবং ক্রমিক বিস্তার। সর্বদেশকালেই , আধুনিকতার এই বিবর্তনসিদ্ধ উদ্ভবের চরিত্র অভিন্ন এবং তার পরবর্তী বিস্তার। এদিক থেকে বলা যেতে পারে আধুনিকতার মৌল লক্ষণ অমিশ্র-বিশুদ্ধ মানবিক কৌতূহল। আসলে মানুষের জীবনযাত্রার যা-কিছু আগ্রহ এবং উদ্যম, সে তার নিজেকে ঘিরেই বরং বলা ভালাে, নিজেকে খুঁজে পাবারই অদম্য আকাঙক্ষায়। বস্তুত মানুষের প্রাথমিক অস্তিত্বটি পড়ে পাওয়া ধন’-প্রকৃতির দাক্ষিণ্যে লব্ধ, তারই নিয়ন্ত্রণে একান্ত বদ্ধ। আপন স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির সমর্থে মানুষ প্রকৃতি-তাড়িত এই জৈব সত্তাকে নিজের মনের মতাে করে গড়তে চায়; সেইখানেই নিজেকে নিয়ে তার সকল কৌতূহলের জন্ম। তখনই প্রশ্ন জাগে, জীবনটা কী,-কেমন করে ও অস্তিত্ব সিদ্ধ হল, কেমন তার পরিণাম? সেই নিরন্তর জিজ্ঞাসুতার চক্রপথে বিবর্তিত হয়ে চলেছে মানুষের দর্শন, বিজ্ঞান, শিল্প; সাহিত্যে সেই শেযােক্তের বিশেষিত অভিব্যক্তি।