"নিজের কাছেই একটু একটু অপরিচিত" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: কবিজীবনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্ম-উন্মােচনের নানান ভঙ্গিতে পাঠকের সামনে উপস্থিত। কখনও ব্যাকরণ-ভাঙা এক তরুণ কবি, কখনও-বা আকুল প্রেমিক, কখনও সমাজ-সচেতন ক্রুদ্ধ এক স্পষ্টবাদী। তার কবিতা-বিশ্বাস কিন্তু কোনও আয়ােজনেই বদলে যায়নি এতটুকু। কৃত্রিমতাকে তিনি বর্জন করেছেন বরাবর। স্বীকারােক্তির নগ্নতাই তার অপরূপ অবলম্বন। জীবনের শেষ পর্বের কবিতাগুলিতে পাঠক টের পাবেন তাঁর ভনিতাহীন স্বর। নিজের কাছেই একটু একটু অপরিচিত কাব্যগ্রন্থের নানা ঢেউয়ে ভেসে উঠেছে স্মৃতি-জীবন্ত মা, স্ত্রী স্বাতী, পুত্র পুপলু। আছে ‘পাগল কোম্পানির মনসবদার’ শক্তি, রূপনারায়ণের কূলে জ্যোৎস্নায় মধুপান উৎসবে “...শক্তির ওগাে কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ শুনে/জল থেকে উঠে আসে এক জলকন্যা...”। স্নেহভেজা প্রেম, জ্যোৎস্নাভেজা রবীন্দ্রগান যে-তীব্রতায় হৃদয়কে আলােড়িত করে, সেই একই তীব্রতায় অতীতের এক নারী এসে বিশেষ স্পর্শ দাবি করে মরণাপন্নের কাছে। স্পষ্ট কোনও এক জাদু খেলা করে যেন। আরও স্পষ্ট হয় মা কিংবা প্রেমিকার মতাে মেয়ে—“যে তােমার পাশেই বসে আছে, কোনও একদিন/তুমি ওর গর্ভে জন্ম নেবে!” মুহূর্ত ভাঙার শব্দে মায়াময়।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।