শোনে পুণ্যবান্ তত্ত্বকথাকে সম্মান জানানো বাঙালিদের ঐতিহ্য। তত্ত্বকথা আকাশ থেকে পড়ে না, বিশেষ ক'রে যদি বাম-ঘেঁষা তত্ত্ব হয়, মস্ত আদর্শের নির্যাসে সিক্ত তা। আদর্শ, ত্যাগ, দেশের ও সমাজের জন্য নিঃস্বার্থ চিন্তা, অনেক অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত নানা সিদ্ধান্ত, সব-কিছু মিলিয়ে-মিশিয়ে, কিছু ভাবনা পরিমার্জনা ক'রে, কিছু ভাবনার সঙ্গে বই-থেকে-পড়া অন্য দেশের ঘটনাবলির কিংবা আমাদের দেশে বা সমাজে অতীতের কোনো দৃষ্টান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা ক'রে, তত্ত্বে পৌঁছুনো। সব তত্ত্বের ভার সমান নয়, কোন্ তত্ত্ব টিকলো কি টিকলো না, সমাজে গুরুত্ব পেলো কি পেলো না তা অনেকটাই ফের নির্ভর করে ইতিহাসের অনেক আকস্মিকতার উপর, যদি যে-সামাজিক-আর্থিক সংস্থানের কল্পনা মনে রেখে তত্ত্বের বিস্তার-বিন্যাসের ছক কাটা হয়েছিলো ক্রমশ-উন্মোচিত-হ’তে- থাকা বাস্তব যদি তা থেকে অনেক দূরে চ'লে যায়, তাহ'লে তত্ত্বকথা আড়ষ্ট তত্ত্বকথা হ'য়েই থাকে, সেই তত্ত্বের প্রয়োগ রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রেক্ষিতে বহু পরিমাণে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফ্যালে, তত্ত্ব তখন তাই স্রেফ প্রাজ্ঞ দর্শনচিন্তা হিশেবে বইয়ের পাতায় গুটিয়ে নেয় নিজেকে। তবে শ্রদ্ধার উপচার সাজিয়ে সেই তত্ত্বকে সম্মান জানাতে ঘাটতি দেখা যায় না, তত্ত্বটি যে সাম্প্রতিক সামাজিক জীবনের জটিল-কুটিল সমস্যাদির বিশ্লেষণের সঙ্গে খাঁজে খাঁজে মেলানো যাচ্ছে না, তার জন্য তত্ত্বের তো কোনো অপরাধ বা দায়বদ্ধতা নেই, তত্ত্বটি যাঁদের মনীষা হ'তে নিঃসৃত হয়েছিলো তাঁদেরও নেই, তাঁদের চিন্তার আন্তরিকতায় তো কোনো খাদ ছিলো না, সমাজকে, সমাজভুক্ত মানুষকে তাঁরা নিবিড় ক'রে ভালোবাসতেন ব'লেই, সামাজিক উত্তরণের স্বপ্নবাসনায় তাঁরা সমাচ্ছন্ন ছিলেন ব'লেই, ত্যাগের-তিতিক্ষার অনেকগুলি অভিজ্ঞতার তেপান্তর পেরিয়ে এসেই তাঁরা কলম ধরেছিলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাঁদের মনের কথাগুলি সন্নিবদ্ধ ক'রে গিয়েছিলেন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণ ক'রে এখন আর তেমন বেশিদূর এগোনো আমাদের পক্ষে বর্তমান অবস্থায় আদৌ সম্ভব নয়, তা ব'লে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য ভ'রে নিয়ে প্রতিনিয়ত তাঁদের বিনয়াবনত চিত্তে স্মরণ করবো না কেন ?
Aoshoke Mitra অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রাবন্ধিক; ‘কবিতা থেকে মিছিলে’র লেখক। অতীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক, কেন্দ্রীয় কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের সভাপতি, ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, পশ্চিমবঙ্গের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং রাজ্যসভার সদস্য। ১৯৯৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। মুম্বইয়ের ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ক্রমিক মন্তব্য ক্যালকাটা ডায়রি’ একসময় পাঠকদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল। তাঁর বাংলা বইগুলির মধ্যে ‘অকথা-কুকথা', ‘অচেনাকে চিনে-চিনে, কবিতা থেকে মিছিলে, ‘নাস্তিকতার বাইরে’, ‘চরিত্রাবলী’, ‘পুরানো আখরগুলি’, ‘সমাজসংস্থা আশানিরাশা’, ইত্যাদি বহুখ্যাত।