"উপন্যাস সমগ্র ৬" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: একালের এক অগ্রগণ্য সমালােচক যথার্থই লিখেছেন: “নদীর কোনও ভান নেই— শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়ের ঔপন্যাসিক সত্তাতেও কোনও ভণিতা নেই। এক প্রাণবন্ত শৈশবস্মৃতি, এক যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞান-সংকট এবং শান্ত নিরাসক্ত অবলােকন— সবার উপরে এক সর্বতােসুভদ্র আস্তিক্য তার লেখক-জীবনকে গড়ে তুলেছে।” বাংলা কথাসাহিত্যের বিরল লেখকদের অন্যতম শীর্ষেন্দুর প্রধান শক্তি তার এই আস্তিক্যবােধ। জীবনের সকল সংশয়ের মধ্যেও তিনি এক অসংশয়িত উত্তরণের কথা উচ্চারণ করেন অপার সাহসে। চারপাশের অন্তহীন দিশাহীনতার মাঝখানে দাড়িয়েও তিনি সাহসী। এখানে তিনি এক অনন্যস্রষ্টা। শীর্ষেন্দুর যে-কোনও কাহিনীতে দেখি চতুর্দিকের সমস্ত বিপন্নতা সত্ত্বেও, মনুষ্যত্বের জন্য মানুষের মানবিক উৎকণ্ঠা দুর্মর’। এই মুহূর্তে এক সংক্ষুব্ধ সময়ের মধ্যে দিয়ে জীবনের পারাপার। তবু তারই মধ্যে মানুষের পবিত্র স্বরূপকে তিনি খােজেন পরম মমতায়। তিনি বিশ্বাস করেন, কোথাও একটা আশ্রয় আছে, ফেরার জায়গা আছে। আস্তিক্যবােধের সঙ্গে এই প্রেমিক অথচ বৈরাগী লেখকের সমগ্র সৃষ্টিতে লগ্ন হয়ে আছে এক অবােধ প্রবল ভালবাসার আকুলতা। তার নিজের কথায়, “এই আকুলতাকে আমি নানাভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি আমার লেখায়। তবু মনে হয়, আমার প্রকাশভঙ্গির ব্যর্থতায় আজও বুঝি সবাইকে আমার ভিতরকার ভালবাসার কথাটা বােঝতেই পারিনি।... আমার অকথিত ভালবাসার কথা কি বােঝে, বুঝতে পারে এই পৃথিবী, এই। কলকাতা, এই দেশ? ভাষা দিয়ে সব কি প্রকাশ করা যায়?” লেখকের আপন সংশয় সত্ত্বেও তার সৃষ্ট। চরিত্ররা বহন করছে ‘সেই ভালবাসার তরঙ্গ। উপন্যাসের শৈলী ও নির্মিতিতে শীর্ষেন্দুর আত্মস্থ অথচ অনাসক্ত ভঙ্গি এবং বীক্ষণ বাংলা কথাসাহিত্যে অন্যমাত্রা সংযােজন করেছে। তার লেখা সমস্ত উপন্যাস এবার খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশের আয়ােজন করা হয়েছে। এই ষষ্ঠ খণ্ডে আছে স্মরণীয় তেরােটি উপন্যাস: গােলাপের কাটা, নানা রঙের আলাে, চোখ, দৃশ্যাবলী, টানাপােড়েন, হারিয়ে-যাওয়া, চুরি, কীট, ওয়ারিশ, গতি, পয়মন্ত, বাঘু মান্নার বরাত, দেশান্তরী।
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।