রাজা নেই তবু রাজার দেশ রাজস্থান। রাজস্থানীরা যে চিরকালের রাজপুত— রাজপুত্র। রাজত্ব গিয়েছে কিন্তু যায়নি তাঁদের রাজকীয় আভিজাত্য আর উদারতা, সাহস ও সহিষ্ণুতা। তাঁদের দেশপ্রেম এবং ধর্মাচরণ আজও সারা ভারতের আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। আমি তাঁদের দেখেছি। দেখেছি হিমালয়ের দুর্গম তীর্থপথের বাঁকে বাঁকে। দেখেছি নাসিক প্রয়াগ আর হরিদ্বারে, বারাণসী গয়া ও গঙ্গাসাগরে। ভারতের অন্য কোন রাজ্যের অধিবাসীরা এত দুঃখ-কষ্ট সয়ে তীর্থদর্শন করেন বলে জানা নেই আমার। আমি তাই তীর্থময় ভারতের বিভিন্ন মন্দিরদ্বারে দাঁড়িয়ে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে রাজস্থানীদের দেখেছি। কিন্তু আমি কখনও দেখি নি রাজস্থান। আমি দেখি নি আরাবল্লীর দুর্ভেদ্য গিরি-প্রাচীর। দেখি নি অম্বরের রাজপ্রাসাদ অথবা চিতোরের বিজয়স্তম্ভ, আজমীরের দরগা কিংবা দিলওয়ারার মন্দির, পুষ্করের জল ও হলদিঘাটের মাটি। তাই তো আমার এই রেলযাত্রা — রাজভূমি-রাজস্থানের নগরে নগরে পথ-পরিক্রমা। কিন্তু সে পরিক্রমার কাহিনী শুরু করার সময় হয় নি এখনো। সবে তো আগ্রাফোর্ট স্টেশন থেকে আমাদের গাড়ি ছাড়ল। শেষ রাতে পৌঁছব জয়পুর। আগামীকাল সকালে সেখানে থেকেই শুরু হবে আমাদের রাজস্থান পরিক্রমা। কাজেই রাজভূমি-রাজস্থানের কথা এখন থাক। তার চেয়ে এইমাত্র আগ্রাফোর্ট স্টেশনে আমার জীবন-নাট্যের যে অন্তিম দৃশ্যটি অভিনীত হয়ে গেল, সেটির কথা বলা যাক্। বলা বাহুল্য সে দৃশ্যের নায়িকা মানসী—আমার ‘মানালীর মালঞ্চে', 'লীলাভূমি-লাহুল’ এবং ‘মধু-বৃন্দাবনে’–র মানসী। যার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় মানালীতে, দ্বিতীয় দেখা বৃন্দাবনে আর তৃতীয় বিদায় এই রাজভূমি রাজস্থান পরিক্রমার পূর্বক্ষণে । কিন্তু মানসীর কথা বলতে হলে যে নিজের কিছু কথাও বলে নিতে হবে—আমার এই যাত্রার কথা। কলকাতার পর্যটন সংস্থা ‘কুণ্ডু স্পেশাল' ‘রিজার্ভড রেলওয়ে কোচ্’-এ এই যাত্রার আয়োজন করেছেন। চারদিন আগে হাওড়া থেকে রওনা হয়ে দিল্লী ঘুরে পরশু রাতে আমরা মথুরা এসেছি। গতকাল ও আজ আমাদের মথুরা-বৃন্দাবন এবং আগ্রা দর্শনের জন্য নির্দিষ্ট ছিল।
Shonku Moharaj বর্তমান বাংলা ভ্রমণ-সাহিত্যের জনপ্রিয়তম নাম। সুগত সাতাশ বছরে তাঁর ছত্রিশটি শিল্পকর্মের মধ্যে তিনখানি বাদে বাকি সবকটিই ভ্রমণকাহিনী। তাঁর পনেরোটি হিমালয়-কাহিনীর শেষখানি ব্রহ্মলোকে। বিগত গ্রন্থে শঙ্কু মহারাজ-এর সারথ্যে পাঠক-পাঠিকার মানস-ভ্রমণ সম্পণ ‘হয়েছে সূদূরবতী’ সুইজারল্যান্ডে, জয়ন্তী জুরিখে। য়ুরোপের আলপস থেকে স্বল্প স্বাদবদল করে লেখক আবার ফিরে এলেন হিমালয়ে, দেশমাতার পূজায় পুনরায় নিজেকে নিবেদন করতে। বিচ্ছেদবাদ যখন ভারতের অঙ্গচ্ছেদনে শামিল, জাতীয় চেতনার সামনে তখুনি তিনি তুলে ধরলেন গুর্জর কিশোরী শ্যামা আর কিশতোয়ারী মালবাহক আবদুল রসিদের কথা, যারা বিদায়বেলায় বাঙালি অভিযাত্রীদের জন্য চোখের জল ফেলে, হিন্দু সাহেবদের নিরাপত্তার জন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কারফিউ কবলিত শহরে ছুটে আসে। বাঙালির কাছে প্রায় অপরিচিত কিশতোয়ার-হিমালয়ের ওপরে রচিত বাংলাসাহিত্যের প্রথম ভ্রমণকাহিনী এই ব্রহ্মলোকে। কলকাতার একদল দামাল যুবক গিয়েছিলেন কিশতোয়ার হিমালয়ের দুগেমতম শৃঙ্গ ব্রহ্মা-১ (২১,০৪৯) পর্বতাভিযানে। লেখক সেই অভিযাত্রীদের অন্যতম। তবে তিনি কেবল পর্বতারোহণ নিয়েই ব্যস্ত থাকেননি। সেই সঙ্গে তাঁর সাবলীল ভাষায় বলেছেন, অনাবিষ্কৃত বিশতোয়ার হিমালয়ের ভাষা ভূগোল ইতিহাস গাছপালা পশু-পাখি পাহাড় ও পথের কথা, বলেছেন সরল ও সুন্দর মানুষদের কথা, যাঁদের সহজ জীবন আর লেখকের সরস লিখন একযোগে পাঠক-পাঠিকাকে নিয়ে যাবে ব্রহ্মলোকের ব্রজ্যায়।