‘সোনালি ডুমুর’ বই এর ফ্ল্যাপের লেখা "দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল উপমহাদেশে ১৯৪৭ সালে। মনুষ্যত্বের অবমাননা দেখা দেয় তারপর। মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয় অসংখ্য মানুষ। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান শত্রু-সম্পত্তি আইন আনলে মনুষ্যত্বের অবমাননার চূড়ান্ত পর্যায় সম্পন্ন হয়। এই পটভূমিতে রচিত হয়েছে সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ‘সোনালি ডুমুর’। উপন্যাসের নায়িকা মাধুরীলতা। শৈশবে ছেচল্লিশের দাঙ্গায় নিহত স্বজনের রক্তে ডুবে থেকে বাঁচতে হয়েছিল মেয়েটিকে। বেঁচে থাকার জন্য তার প্রত্যাশা অনেক। সে পরাজিত মানুষ হতে চায় না। ভালবাসার মানুষ অনিমেষকে খুঁজে নেয়। শ্মশানে নিজের দিদিমার সৎকারের সময় দাদুকে বলে, মুখাগ্নি করবে অনিমেষ। গড়ে ওঠে অনিমেষের সঙ্গে মাধুরীলতার প্রেমের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক বিয়েতে স্থিত হলেও দু'জনেই দেখে কীভাবে ডা. মন্মথনাথ নন্দীর বাড়ি দখল করে সরকার শত্রু সম্পত্তি আইন খাটিয়ে। লুট হয়ে যায় বাড়ি। আর সেই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নিরন্ন মানুষেরা চিৎকার করে, ডাক্তারবাবু আপনি ফিরে আসুন। 'সোনালি ডুমুর' উপন্যাসে নানা ঘটনায় তোলপাড় হয়ে যাওয়া মানুষের জীবনের ছবি। বিশেষ সময় যেন জীবন্ত হয়ে আছে এই উপন্যাসে।"
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।