আজ ছত্রিশ বছর ধরে একাদিক্রমে ‘দেশ’ সাপ্তাহিক সাহিত্য-পত্রিকার সঙ্গে আমি যুক্ত আছি। মহাকালের পরিপ্রেক্ষিতে এসময়টাকে একটা কেন, তিনটে যুগ বলেও ধরা যায়। ১৯৪০ সালে আরম্ভ করি এই কাজ, এখন ১৯৭৬ সাল। বর্তমান বিজ্ঞান-শাসিত পৃথিবীতে স্থান এবং কালের সংকীর্ণতা ঘটলেও সময়ের কাঁটা যেমন অনাদিকাল থেকে অধুনা পর্যন্ত সেই একই নিয়মে ঘুরে চলেছে, যুগের আঙ্কিক হিসেবটার বেলাতেও তাই। এখনও যখন বারো মাসে বছর গোনা হয়, সাত দিনে সপ্তাহ হিসেব করা হয়, এবং ষাট মিনিটে ঘণ্টা নির্ধারিত হবার নিয়ম আছে—যুগের বেলাতেই বা সেই পুরনো আইনটা চলবে না কেন ? শুনেছি যুগ নাকি আবার বদলায়ও, যুগের অদল-বদল আদিযুগ থেকেই হয়তো চালু আছে। যদি সত্যিই তার অদল-বদল হয় তো তা এত মন্দগতিতে যে, তার নিরিখ সমসাময়িক ব্যারোমিটারে ধরবার মতো কোনও সূক্ষ্ম যন্ত্র আজও আবিষ্কৃত হয়নি। এ বদল ধরা একদিন হয়তো পড়বে তুলনামূলক ইতিহাসের কেতাবে— তাও বহুযুগ পরে। সুতরাং আমি এখানে আমার যে অভিজ্ঞতার কাহিনি আপনাদের বলব তা যুগ-বদলের কাহিনি তো নয়ই, যুগের ইতিহাসও নয়। এগুলো নিছক কাহিনি হিসেবে উপাদেয় বলেই বলব। আর তার কোনও তাত্ত্বিক মূল্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টাও যেন কেউ না করেন। তত্ত্ব এক জিনিস আর কাহিনি আর এক জিনিস। তত্ত্ব নিয়ে বচসার অবকাশ থাকে। পণ্ডিতেরা তত্ত্ব নিয়ে বৃহদাকার গ্রন্থ রচনাও করে থাকেন। সে তত্ত্বের টীকাকার ব্যাখ্যাকার যাঁরা, তত্ত্ব-কণ্টকে তাঁদেরও রাত্রের ঘুম আর দিবসের বিশ্রাম বিঘ্নিত হয় বলে শুনেছি। আমি নিষ্কণ্টক না হলেও নিরুপদ্রব শান্তির পক্ষপাতী। তার উপর নানা মতাবলম্বী লেখক-লেখিকাদের নিয়ে আমার কাজ চালাতে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমি যা লিখব পাঠকবর্গ তা নিছক কাহিনি বলে ধরে নিলেই আমি খুশি হব। তা সত্যই হোক আর অসত্যই হোক। বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয়ে লিখে গেছেন—“সদা সত্য কথা কহিবে।” আদালতে সাক্ষী দেবার আগে “সত্য বই মিথ্যা বলিব না” বলে শপথ নেবার রীতি আজও প্রচলিত আছে। স্বাধীন ভারত-রাষ্ট্রের প্রতীক ত্রিসিংহ মূর্তির সঙ্গে স্পষ্টাক্ষরে লেখা থাকে—“সত্যমেব জয়তে।” চারিদিকে এত সত্যের ছড়াছড়ির মধ্যে আমি অসত্য কাল্পনিক কাহিনি শোনাব এত দুঃসাহস আমার নেই।
Sagarmoy Ghosh (২২ জুন, ১৯১২ - ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯) একজন স্বনামখ্যাত ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক যিনি কলকাতা থেকে প্রকাশিত দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় দায়িত্ব পালন করে জীবন্ত কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুতে লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত শোকসংবাদে তাকে বাংলার ‘সাহিত্য ব্যাঘ্র’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। মৃত্যুর কিছু পূর্বে ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী বাংলা সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।