কুলদীপ সিং-এর সঙ্গে অর্জুনের পরিচয় হয়েছিল একটু অদ্ভুতভাবে। গয়েরকাটা হয়ে নাথুয়াতে যাচ্ছিল সে তার বাইকে চেপে। নাথুয়া থেকে চিঠি লিখেছিলেন দিবাকরবাবু। জলপাইগুড়ির জেলা স্কুলে পড়ার সময় যেসব শিক্ষক খুব ছাত্রপ্রিয় ছিলেন দিবাকরবাবু তাঁদের একজন। বিয়ে-থা করেননি। স্কুলের পাশেই একটা ঘর ভাড়া করে একাই থাকতেন। অর্জুন ওঁকে কখনও গম্ভীর মুখে দেখেনি। অবসর নেওয়ার পর তিনি কোথায় চলে গিয়েছেন সেই খবর জানা ছিল না। তার অনেক আগেই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে এসেছিল সে। এই দিবাকরবাবুর চিঠি এসেছিল তার নামে, স্কুলের ঠিকানায়। স্কুলের দারোয়ান সেটা বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিল। চিঠিতে দিবাকরবাবু লিখেছেন, “এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছোবে কি না জানি না। তোমার কথা বিভিন্ন পত্রিকায় পড়ি। সবাইকে যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা বড় চাকুরে হতেই হবে, তার কী মানে আছে? তুমি তো তার থেকে বহু যোজন দূরের পেশা বেছে নিয়েছ। তাই মনে হল, তোমাকে দরকার। ধরে নাও, ছাই নিয়ে বসে আছি, তুমি যদি তা থেকে অমূল্যরতন পেতে পারো তা হলে তার কৃতিত্ব তোমার। গয়েরকাটা হয়ে খুঁটিমারির জঙ্গল পেরিয়ে নাথুয়াতে এসে নাম বললেই যে-কেউ আমার আস্তানা দেখিয়ে দেবে। আমি বিখ্যাত ডায়না নদীর পাশেই থাকি। আশীর্বাদ নিয়ো ।
১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়িতে জন্ম বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক সমরেশ মজুমদারের। তাঁর শৈশব কাটে প্রকৃতির কোলে, চা বাগানে ঘুরে, আদিবাসী শিশুদের সাথে খেলে। এ কারণেই সমরেশ মজুমদার এর বই সমগ্রতে বারবার উঠে আসে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি, চা বাগান, বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ের কথা। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় জলপাইগুড়ির জেলা স্কুল থেকে। এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। গ্রুপ থিয়েটারের প্রতি তাঁর ছিল ভীষণ ঝোঁক। মঞ্চনাটকে চিত্রায়নের উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম ‘অন্তর আত্মা’ নামের একটি গল্প রচনা করেছিলেন। সেই গল্পে নাটক মঞ্চায়িত না হলেও পশ্চিমবঙ্গের পাক্ষিক সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এ প্রকাশিত হয় গল্পটি। সেই থেকেই শুরু তাঁর লেখকজীবন। সমরেশ মজুমদার এর বই বাংলাদেশের প্রচুর মানুষ পড়েন, পড়তে ভালোবাসেন। দুই বাংলাতেই তিনি সমান জনপ্রিয়। তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবে বিখ্যাত হলেও, ছোটগল্প, কিশোর উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্যসহ, গোয়েন্দাকাহিনীও রচনা করেছেন। সমরেশ মজুমদার এর বই সমূহ, যেমন- সাতকাহন, গর্ভধারিণী, মৌষকাল, ট্রিলজি- উত্তরাধিকার-কালবেলা-কালপুরুষ, আট কুঠুরি নয় দরজা ইত্যাদি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র অনিমেষ, মাধবীলতা, দীপাবলী আর জয়িতা পাঠকমনে আজও বিরাজমান। সাহিত্যে তাঁর অনন্য এবং অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বিভিন্ন সময়ে আনন্দ পুরস্কার, সত্য আকাদেমী পুরষ্কার, বঙ্কিম পুরস্কার এবং আইআইএমএস পুরস্কার অর্জন করেছেন।