"ইতল বিতল"বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: শিশুদের জন্যে সুফিয়া কামালের ছিল অপরিসীম ভালবাসা, স্নেহ। তাঁর প্রতিদিনকার আচরণে, ব্যবহারে, সম্পর্কে প্রকাশ পেত সেই স্নেহ। এছাড়া তিনি জানতেন শিশুদের একটি বিশেষ ভাষা হল ছড়া। তাই তিনি ছড়াকে খুবই গুরুত্ব দিতেন। ছড়া পড়তেন, শুনতেন, বলতেন এবং সব রকম সাহিত্য ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যস্ত থেকেও লিখে গেছেন বহু ছড়া। তাঁর ছড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু প্রকাশিত বইয়ে, পত্রিকায়, তাঁর লেখার খাতায় এবং দেশে-বিদেশে, আনাচে, কানাচে শিশুদের অটোগ্রাফ বইয়ে, স্কুলের খাতার পাতায় বা কোন একটি অনুষ্ঠানের ঘােষণাপত্রে যা কোন একটি শিশু তুলে ধরেছে তার সামনে একটি ছড়া লিখে দেওয়ার আবদার জানিয়ে। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে বসেও তিনি হাসিমুখে অনায়াসে লিখে দিয়েছেন একটির পর একটি ছড়া। হাসি ফুটিয়েছেন সেই শিশুদের মুখে। সুফিয়া কামাল (১৯১১-১৯৯৯) লিখেছেন ১২টি কবিতার বই, প্রায় সমসংখ্যক কবিতার বই প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচিত শিশুতােষ, ছােটগল্প, নাটক, উপন্যাস, আত্মজীবনী ও ভ্রমণকাহিনী। তাঁর কবিতা বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যার মধ্যে আছে ইংরাজি, রাশিয়ান, জার্মান, ইতালিয়ান, পােলিশ, চীনা, ভিয়েতনামি, হিন্দি এবং উর্দু। দেশে- বিদেশে তিনি সম্মানিত হয়েছেন প্রায় ৫০টি পদক ও পুরস্কারে । সুফিয়া কামালের একগুচ্ছ ছড়া নিয়ে ইতল বিতল’ প্রথমবার প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে। চট্টগ্রাম থেকে বইটি প্রকাশ করেন সৈয়দ মােঃ শফি, তার শিশু সাহিত্য বিতানের মাধ্যমে। ছড়াগুলাের সাথে ছবি ও প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন তখন তরুণ, আজ প্রখ্যাত শিল্পী হাশেম খান। এবারে মূল বইটি সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রেখেই বইটি প্রকাশ করেছেন সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ। ‘ইতল বিতল’ আবারও হাতে পেয়ে শিশুরা আনন্দ পাবে এ আশা করে, সুফিয়া কামালের পরিবার ও সাঁঝের মায়া ট্রাস্টের পক্ষ থেকে উলি-খিত সকল ব্যক্তিকে এবং তাদের প্রকাশনাকে জানাচ্ছি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।
Sufia Kamal (জন্ম: ২০শে জুন, ১৯১১ - মৃত্যু: ২০শে নভেম্বর, ১৯৯৯) বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও নারী আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ হিসেবে অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব।তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আব্দুল বারী এবং মাতার নাম সৈয়দা সাবেরা খাতুন। তাঁর বাবা কুমিল্লার বাসিন্দা ছিলেন। যে সময়ে সুফিয়া কামালের জন্ম তখন বাঙালি মুসলিম নারীদের গৃহবন্দী জীবন কাটাতে হত। স্কুল-কলেজে পড়ার কোন সুযোগ তাদের ছিলো না। পরিবারে বাংলা ভাষার প্রবেশ একরকম নিষিদ্ধ ছিল। সেই বিরুদ্ধ পরিবেশে সুফিয়া কামাল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাননি। তিনি পারিবারিক নানা উত্থানপতনের মধ্যে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে সুফিয়ার যখন সাত বছর বয়স তখন তাঁর বাবা সাধকদের অনুসরণে নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। ফলে তাকে তার মা সাবেরা খাতুন অনেকটা বাধ্য হয়ে বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন। এই কারণে তাঁর শৈশব কেটেছিল নানার বাড়িতে। যে পরিবারে সুফিয়া কামাল জন্মগ্রহণ করেন সেখানে নারীশিক্ষাকে প্রয়োজনীয় মনে করা হত না। তাঁর মাতৃকুল ছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের এবং সেই পরিবারের কথ্য ভাষা ছিল উর্দু। এই কারণে অন্দর মহলে মেয়েদের আরবি, ফারসি শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও বাংলা শেখানোর কোন ব্যবস্থা ছিল না। তিনি বাংলা শেখেন মূলত তাঁর মায়ের কাছে। নানাবাড়িতে তাঁর বড় মামার একটি বিরাট গ্রন্থাগার ছিল। মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় এ লাইব্রেরির বই পড়ার সুযোগ ঘটেছিল তাঁর। ১৯২৪ সনে মাত্র ১৩ বছর বয়সে মামাত ভাই সৈয়দ নেহাল হোসেনের সাথে সুফিয়ার বিয়ে দেয়া হয়। নেহাল অপেক্ষাকৃত আধুনিকমনস্ক ছিলেন, তিনি সুফিয়া কামালকে সমাজসেবা ও সাহিত্যচর্চায় উৎসাহিত করেন। সাহিত্য ও সাময়িক পত্রিকার সঙ্গে সুফিয়ার যোগাযোগও ঘটিয়ে দেন তিনি। সুফিয়া সে সময়ের বাঙালি সাহিত্যিকদের লেখা পড়তে শুরু করেন। ১৯১৮ সালে কলকাতায় গিয়েছিলেন সুফিয়া কামাল। সেখানে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিলো। সুফিয়া কামালের শিশুমনে বিশেষ জায়গা করে নিয়েছিলো বেগম রোকেয়ার কথা ও কাজ। সুফিয়া কামালের কাজেকর্মেও ছাপ পাওয়া যায় বেগম রোকেয়ার। ১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর ঢাকায় সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।