১৯৪৪ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টানা পাঁচ মাসের মধ্যে এই বইখানি আমেদনগর দুর্গের কারাশিবিরে আমি লিখি। আমার সহকারী বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ অনুগ্রহ করে এর পাণ্ডুলিপি পড়ে দেখেন ও এর বিষয়ে নানাবিধ মূল্যবান মন্তব্য প্রকাশ করে আমার সহায়তা করেন। কারাবাসকালে বইখানি পুনর্লিখনের সময় আমি তাঁদের সেইসব মন্তব্যের সম্পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছি ও মূল লেখায় কিছু কিছু সংযোজন করেছি। বলা বাহুল্য আমি যেসব মতামত প্রকাশ করেছি তার সম্বন্ধে তাঁদের কোনো দায়িত্ব নেই, সকল বিষয়ে তাঁরা যে আমার সঙ্গে একমত তাও নয়। সে যাই হোক, আমেদনগর কারাশিবিরে আমার সহবন্দীদের প্রতি আমার গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ-এই সুযোগে না করে পারছি না। তাঁদের সঙ্গে নানাবিধ আলাপ আলোচনায় ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে আমার ধারণা বহুলাংশে স্পষ্টতর- হয়েছে। ছোট মেয়াদের কারাবাসও খুব উপভোগ্য নয়, দীর্ঘ মেয়াদের কারাবাস তো নয়ই। তা সত্ত্বেও এ আমার নিতান্ত সৌভাগ্য যে এবার আমি এমন সব কৃতী ও সংস্কৃতিবান মনস্বীদের নিকট সম্পর্কে এসেছিলাম-যাঁদের উদার মনোবৃত্তি সাময়িক উত্তেজনার ফলেও মোহগ্রস্ত হয়ে যায়নি। আমেদনগর কারাশিবিরে আমার যে-এগারোজন সঙ্গী ছিলেন, তাঁরা নানাদিক দিয়ে ছিলেন ভারতবর্ষের প্রতিনিধিস্থানীয় রাজনীতিতে তো বটেই, সংস্কৃতির দিক থেকেও প্রাচীন ও আধুনিকপন্থী মনীষার তাঁরা ছিলেন প্রতিভূস্বরূপ। প্রাচীন ও আধুনিক যেসব ভারতীয় ভাষা অতীত ও বর্তমানকালের জাতীয় জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করেছে, সেই সকল ভাষারই প্রতিনিধিত্ব করার মত যোগ্যতা ও পাণ্ডিত্য ছিল এঁদের। প্রাচীন ভাষার মধ্যে ছিল সংস্কৃত ও পালি, আরবী ও ফারসী; এবং আধুনিক ভাষার মধ্যে ছিল হিন্দি, উর্দু, বাংলা, গুজরাতি, মারাঠি, তেলেগু, সিন্ধি ও উড়িয়া। জ্ঞানের এই বিরাট ঐশ্বর্যভাণ্ডার আমার কাছে উন্মুক্ত ছিল, তার যদি সম্পূর্ণ সুযোগ আমি না নিতে পেরে থাকি, তাহলে সে অক্ষমতা আমার নিজেরই। যদিও আমার সঙ্গীদের সকলের কাছেই আমি সমভাবে কৃতজ্ঞ, তবু বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, নরেন্দ্র দেব এবং আসফ আলীর নাম। মৌলানার বিরাট পাণ্ডিত্য আমায় মুগ্ধ করেছে, অভিভূত করেছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ও স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর ব্যারিস্টারি পেশা ছাড়াও আরেকটি পরিচয় আছে। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশই নয়, বিশ্বপাঠকের কাছে তিনি একজন সমৃদ্ধ লেখক। পণ্ডিত নেহরু এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন, ১৮৮৯ সালের ১৪ই নভেম্বর। পনেরো বছরের কিশোর নেহরু বিলেতে পাড়ি জমান, প্রাথমিক শিক্ষার পরের পাটটা বিলেতেই সম্পন্ন হয়। বিলেতে তিনি পড়াশোনা করেছেন হ্যারো ও কেম্ব্রিজে। পড়াশোনা শেষ করার পর পেশা হিসেবে বেছে নেন ব্যারিস্টারিকে। তিনি দেশে ফেরেন ১৯১২ সালে। ফেরার পরই সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, সেসময় বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করেছে। অনেকদিন বিদেশে থাকার ফলে অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প তাঁকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করে এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সফলতার মুখ দেখবার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে পড়েন। অসহযোগ আন্দোলনের সময়টাতে দু’বার কারাবরণও করেন নেহরু। মহাত্মা গান্ধী দ্বারা তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। জওহরলাল নেহরু এর বই সমগ্র পড়লে তাঁর ব্যক্তিজীবনের দর্শন, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনেকটাই জানতে পারা যায়। কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর ছোটবেলায় তাঁর কাছে কিছু চিঠি লিখেছিলেন নেহরু। সে চিঠিগুলো পরে বই আকারে প্রকাশ পায়, ‘লেটারস ফ্রম অ্যা ফাদার টু হিজ ডটার’ নামে; যা পরবর্তীতে বাংলা ভাষায় ‘বাবার চিঠি’, ‘মেয়ের কাছে বাবার চিঠি’ বা ‘কল্যাণীয়াসু ইন্দু’ নামে অনূদিত হয়েছে। শিশু-কিশোরবান্ধব এই বইটিতে পৃথিবীর ইতিহাস, দর্শন সম্পর্কে সহজ ভাষায় অনেক কিছু বলা হয়েছে যা কি না অনেক কম বয়সেই শিশুদের মনের দরজা-জানালা খুলে দিতে ভূমিকা রাখতে পারে। জওহরলাল নেহরু এর বই সমূহ সাধারণত ইতিহাসকেন্দ্রিক ও তাঁর রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত। ‘পৃথিবীর ইতিহাস’, ‘দ্য ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’, ‘টুওয়ার্ড ফ্রিডম’ বইগুলো তাঁর বেশ বিখ্যাত লেখনীর অন্তর্ভুক্ত। এসব বইয়ের তালিকায় তাঁর আত্মজীবনীও রয়েছে।