মিথ, পুরান, কাব্যে, সঙ্গীতে, চিত্রে যুগে যুগে বস্ত্রের স্তুতি হয়েছে। আজও হচ্ছে কিন্তু এসব নিয়ে তার সৃষ্টি যে ঘরে, যে হাতে, যে পরিবেশে তাদের স্তুতি নয়, তাদের শিল্প সৃষ্টির পেছনে আনন্দ বেদনা হতাশার চিত্র নিয়ে নয় মোট কথা তাঁতি জীবন বা তাঁতকলে বাঁধা টানাপোড়েন এর জীবনে বন্দী তাঁতশিল্পীদের জীবনকথা বরাবরই থেকেছে উপেক্ষিত। বাহুল্য কথার চাপে, নানা স্তুতির চাপে রঙীন সুতায় তোলা নকশার ঔজ্বল্যে বুঝিবা বারবার হারিয়ে গেছে, মিইয়ে গেছে তাঁতিদের ‘অনুজ্বল’ জীবনালেখ্যটি। যারা মনের মাধুরি মিশিয়ে বস্ত্রের নিখুঁত জমিন অলংকরন করে অঙ্গাবরণ তৈরির স্রষ্টা হন তারা কি করে নিরলংকার থাকেন? মোক্ষম প্রশ্ন হতে পারে বৈকি। যে শিল্পীমন সর্বদা ব্যস্ত টানাপোড়েনে শিল্পবস্তু রচনায় সে বোকা, নীচুজাত, বুদ্ধিহীন, বেয়াকুফ হতে পারে? খুব চালাক চতুর তাঁরা নাইবা হলেন কিন্তু বোকা-উজবুক হতে যাবেন কেন? নাকি যারা বংশ পরম্পরায় তুলা ধুনে, আঙ্গুলে টিপে সুতা তৈরি করে, তা নানা রঙে রঞ্জিত করে বহুবর্ন নকশায় বস্ত্র বোনে অথচ নিজের জীবনটা রঙে নকশায় বুনে তথা ধনে- গৌরবে রাঙিয়ে তুলতে জানেনা, ফলে তাদের অদৃষ্টে এসব সামাজিক কটাক্ষ অসদাচারই বুঝি ভবিতব্য হয়! এই রচনা একটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সৃষ্টি। যা অতিকথন যেমন নয় আবার কথিত কথন ও নয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোকে তন্তুবায় শিল্প ভুবন কে দেখা ভিন্ন এক মানবিক দরদে, শৈল্পিক দৃষ্টিতে ও স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে।
স্কুলশিক্ষক বাবা ও গৃহকত্রী মায়ের চতুর্থ সন্তান। ছােটবেলায় দেখা ‘মা’ আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সর্ববিশারদ, যার শিল্পসুষমা ছিল বিচিত্র কারুবাসনা ঘিরে। একদিন মায়ের শস্য ও কারুবাসনার সংসার থেকে ‘বিদ্যাবাসনার নিমিত্তে ঘর ছাড়তে হলাে নাবালক বয়সে অবধারিত বিপত্তি এড়িয়ে, ডিঙিয়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক, পথেঘাটে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ। কলাভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে তন্তুকলা তথা বয়নচিত্র ও ভাস্কর্য (ট্যাপেস্ট্রি ও ফাইবার স্কাল্পচার) বিষয়ে স্নাতকোত্তর। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন কয়েক বছর। বাংলার চারু-কারু অনুষঙ্গ নিয়ে তাঁর নিত্যভাবনার পাঁচালি, যার মধ্যে বাংলার বয়ন ও কারিগর পেশার অন্ত্যজদের নিয়ে সুলুকসন্ধানে বিশেষ উৎসাহী। ফলে এ সংক্রান্ত নিরন্তর গবেষণা লেখালেখি । তচর্চা, সন্তানদ্বয় ‘বয়ন’ ও ‘বৈভব’-এর যত্ন-আত্তি আর ‘টানাপােড়েন’ সংগত করা তাঁর নৈমিত্তিকযাপন নৈবেদ্যস্বরূপ। দীর্ঘ অভিবাসী জীবনে জীবিকার জন্য সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে ‘তকাজে ব্যাপৃত থাকলেও পড়া-লেখালেখির নিমিত্তে অসংখ্য শব্দরাশি নিয়ে নিত্যদিনের কাটাকুটি। লেখেন মূলত শিল্পকলা বিষয়ে, তবে সংখ্যায় বেজায় কম চিন্তায় কোনাে গুরুনির্দেশ বা বিধিবিধান খাটে না। সঠিক মাত্রায় বাঁধবার আয়াসে বরং বােধ ও প্রাণের ফজিলত শিল্পায়তে নাজিল হয়। প্রকাশিত পুস্তকাদি ‘শিল্পমনীষা’ (২০০১), ‘তদ্ভুকলা ও ট্যাপেস্ট্রি’ (২০০৪), ‘পরনকথা নগরদাইর’, ‘ভিঞ্চি নােটস্’, ‘শিল্পদর্শন’ (২০১০), তন্তুবায় স্বরূপ সন্ধান (২০১৪), ‘মানুষ ভজে রং তুলিতে, ‘শিল্পবয়ান' (২০১৯)। ফসলের আদিম শরীর থেকে বুনাে আমােদে গন্ধ-ছডানাে আরণ্যক গ্রাম বুকে নিয়ে পথিবীর নানা শহরে-গঞ্জে পিঠ ঠেকিয়েছেন বিবিধ ওসিলায়। গত দেড়দশক ধরে শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন ইউরােপ-অভিবাসী। দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে উত্তর-ইতালির মিলান শহরে। সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে বর্তমানে ইংল্যান্ডের লাফবরা শহরে স্ত্রী ও দুই পুত্রসন্তান নিয়ে বসবাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের বয়ন ঐতিহ্যের প্রাণভূমি নরসিংদী জেলার এক ছােট সবুজ গ্রামে একদা জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলেটি আজ পাশ্চাত্যে তাঁতে পােড়েনের রঙে, নকশায়, বুননে হাজির করে স্মৃতি ছবির মগ্নতা।