শিল্পকলা বিষয়ে যা বলা হয়েছে এই পুস্তিকায়, তা এক কথায় বীক্ষণ। বলা যায় ‘পর্যবেক্ষণ’। লেখক ললিতকলা বা শিল্পকলা বিষয়ে তাঁর দেখা, বুঝাপড়া অনুসন্ধান উত্থাপন করেছেন নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে। একদা শিল্প শিক্ষালয়ে শিক্ষকতার সুবাদে শিল্প বিষয়কে যেমন বিদ্যায়তনিক পঠন পাঠনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে উদ্যোগী হন, আবার একজন স্বাধীন শিল্পজীবী হিসাবে উদার সার্বভৌম দৃষ্টিভঙ্গিও ধারণ করেন। উপরন্তু তথাকথিত পাশ্চাত্য আধুনিকতা ও উন্নয়নের নামে চাপিয়ে দেওয়া ঔপনিবেশিক স্বার্থের কর্মকাÐকে জাতির প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তা ও স্বার্থের অবস্থান থেকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উৎসাহী। দেখা বুঝার এমনতরো অবস্থান থেকে শিল্পে মহামারি, জীবজন্তু চিত্রণের কথার সাথে আছে শিল্পকর্মে সাহিত্য প্রভাব, আছে প্রতœ শিল্পকলা বেহাত বা লুটের ক্ষেত্রে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ও বণিক শক্তির প্রত্যক্ষ যোগসাজস। লেয়নার্দো দা ভিঞ্চির শেষ নৈশভোজের পূর্বাপর যেমন আছে তেমনি আছে ভ্যানগঘের নক্ষত্রখচিত রাতের কথা। আছে মূল ইতালিয়ান শিল্পকথার তর্জমা। আবার দেশীয় বয়ন শিল্প ঐতিহ্য মসলিনের ব্রিটিশ উৎপাদন এর প্রপঞ্চ নিয়েও আছে জরুরি সমকালীন পর্যবেক্ষণ। শিল্পতাত্তি¡ক ও গবেষকরা তাদের মতো করে শিল্প ইতিহাস ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেন তাঁদের বিশিষ্ট চিন্তার আলোকে কিন্তু এরই পাশাপাশি বিশেষ চিন্তা ও পর্যবেক্ষণ কোনো কোনো শিল্প ভাবুক ‘শিল্পবীক্ষণ’র নানা রহস্যের কথা জানাতে চান। এমনই একজন শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন। বলা বাহুল্য তিনি শিল্প পরিক্রমার দিকে যে ভঙ্গিতে তাকিয়েছেন ‘শিল্পবীক্ষণ’সে আলেখ্যেরই ধারক। আলোচ্য গ্রন্থটিতে নানা তত্ত¡ ও তথ্যকে এক স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন লেখক। কাঠিন্য কমই তবে কঠিন কথা একবারে নেই তা নয়, কিন্তু প্রকাশের ভঙ্গিমার গুণে তা সুবোধ্য ও সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। নতুন কথা আছে বিস্তর। বিশেষত বাংলা ভাষায় অনালোচিত পাশ্চাত্যে চর্চিত শিল্প পর্যবেক্ষণ ভিন্ন আলোকে উপস্থাপন আকর্ষণীয়।
স্কুলশিক্ষক বাবা ও গৃহকত্রী মায়ের চতুর্থ সন্তান। ছােটবেলায় দেখা ‘মা’ আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সর্ববিশারদ, যার শিল্পসুষমা ছিল বিচিত্র কারুবাসনা ঘিরে। একদিন মায়ের শস্য ও কারুবাসনার সংসার থেকে ‘বিদ্যাবাসনার নিমিত্তে ঘর ছাড়তে হলাে নাবালক বয়সে অবধারিত বিপত্তি এড়িয়ে, ডিঙিয়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক, পথেঘাটে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ। কলাভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে তন্তুকলা তথা বয়নচিত্র ও ভাস্কর্য (ট্যাপেস্ট্রি ও ফাইবার স্কাল্পচার) বিষয়ে স্নাতকোত্তর। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন কয়েক বছর। বাংলার চারু-কারু অনুষঙ্গ নিয়ে তাঁর নিত্যভাবনার পাঁচালি, যার মধ্যে বাংলার বয়ন ও কারিগর পেশার অন্ত্যজদের নিয়ে সুলুকসন্ধানে বিশেষ উৎসাহী। ফলে এ সংক্রান্ত নিরন্তর গবেষণা লেখালেখি । তচর্চা, সন্তানদ্বয় ‘বয়ন’ ও ‘বৈভব’-এর যত্ন-আত্তি আর ‘টানাপােড়েন’ সংগত করা তাঁর নৈমিত্তিকযাপন নৈবেদ্যস্বরূপ। দীর্ঘ অভিবাসী জীবনে জীবিকার জন্য সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে ‘তকাজে ব্যাপৃত থাকলেও পড়া-লেখালেখির নিমিত্তে অসংখ্য শব্দরাশি নিয়ে নিত্যদিনের কাটাকুটি। লেখেন মূলত শিল্পকলা বিষয়ে, তবে সংখ্যায় বেজায় কম চিন্তায় কোনাে গুরুনির্দেশ বা বিধিবিধান খাটে না। সঠিক মাত্রায় বাঁধবার আয়াসে বরং বােধ ও প্রাণের ফজিলত শিল্পায়তে নাজিল হয়। প্রকাশিত পুস্তকাদি ‘শিল্পমনীষা’ (২০০১), ‘তদ্ভুকলা ও ট্যাপেস্ট্রি’ (২০০৪), ‘পরনকথা নগরদাইর’, ‘ভিঞ্চি নােটস্’, ‘শিল্পদর্শন’ (২০১০), তন্তুবায় স্বরূপ সন্ধান (২০১৪), ‘মানুষ ভজে রং তুলিতে, ‘শিল্পবয়ান' (২০১৯)। ফসলের আদিম শরীর থেকে বুনাে আমােদে গন্ধ-ছডানাে আরণ্যক গ্রাম বুকে নিয়ে পথিবীর নানা শহরে-গঞ্জে পিঠ ঠেকিয়েছেন বিবিধ ওসিলায়। গত দেড়দশক ধরে শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন ইউরােপ-অভিবাসী। দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে উত্তর-ইতালির মিলান শহরে। সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে বর্তমানে ইংল্যান্ডের লাফবরা শহরে স্ত্রী ও দুই পুত্রসন্তান নিয়ে বসবাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের বয়ন ঐতিহ্যের প্রাণভূমি নরসিংদী জেলার এক ছােট সবুজ গ্রামে একদা জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলেটি আজ পাশ্চাত্যে তাঁতে পােড়েনের রঙে, নকশায়, বুননে হাজির করে স্মৃতি ছবির মগ্নতা।