চারুকলা বিষয় অন্তর্গত প্রবন্ধ-নিবন্ধ সংকলন এই চারুবয়ান, পুস্তকে নামাঙ্কিত ‘শিল্পবয়ান’। এ গ্রন্থের শিল্পকলাবিষয়ক রচনায় আছে, অভিবাসী এই শিল্পী-গবেষক-লেখকের নিজের আয়োজন প্রয়োজনকল্পে, সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজ, ভঙ্গিতে মূলত ফিরে দেখা। চোখস্থ, মুখস্থ, ঠোঁটস্থ, বহিস্থ লেখ্য নানাবিধ শিল্প-অনুধ্যায়ের সম্মিলন এই পুস্তক-কায়াতে তর্পিত রইল। তিনি নিজস্ব দেখনভঙ্গির সাতসতেরো ভাগজোক করে নিতে চান পাঠকের সাথে। ফলত নানা সময়ে এসব প্রকাশিত হয়েছে দেশের প্রথিতযশা পত্রপত্রিকায়। পুরনো ও আধুনিকতার যুগলবন্দি সেসব শিল্পকথারা। গত শতকের ইতালিয়ান শিল্পকলা আন্দোলনের হালহকিকত যেমন আছে, তেমনি আছে শিল্পী ভিঞ্চি, ভ্যান গঘ, দেগা, মন্দ্রিয়ান, ক্যানদিনস্কি থেকে টুবিয়াস বুখে। ‘শিল্পে ধর্ম, রাজনীতি ও যুদ্ধ’ নিয়ে আলোচনা করতে করতেই হাল আমলের দেবীর মÐপসজ্জায় যুক্ত স্থাপনাশিল্পের কায়কারবার নিয়ে কথা। গ্রাফিত্তি, স্ট্রিট আর্টের প্রসঙ্গ থেকে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে শিল্প, শিল্পীদের সংগ্রামমুখর শিল্পপ্রয়াসের কথা আছে। জয়নুল ভাবশিষ্য শিল্পী রশিদের লগে চিন-পরিচয়ের সূত্রাসূত্র আলাপে আসার সাথে সাথে তন্তুকলা আন্দোলন ও তার শিল্প-অভিব্যক্তি নিয়ে বিশ্লেষণ। ‘আর্ট মেনিফেস্টো’ আর শিল্প ‘না-বুঝারও বিলাসিতা হয়?’-গোছের আলোচনা হয়ে উঠবে যে-কোনো মাত্রার শিল্পকলা বিষয়ে উৎসাহী পাঠকের শিল্পচিন্তার খোরাক। সহজাত শিল্প-অভিজ্ঞা, চর্চা লেখকের শিল্পীমনের সারাৎসার তাঁর গদ্যশৈলীতে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। অতএব পাট্টাকবুলতিসমেত রচনা সকল পাঠকমন সমীপে পাঠ শুভক্ষণের জন্য প্রস্তুত রইল।
স্কুলশিক্ষক বাবা ও গৃহকত্রী মায়ের চতুর্থ সন্তান। ছােটবেলায় দেখা ‘মা’ আক্ষরিক অর্থেই ছিলেন সর্ববিশারদ, যার শিল্পসুষমা ছিল বিচিত্র কারুবাসনা ঘিরে। একদিন মায়ের শস্য ও কারুবাসনার সংসার থেকে ‘বিদ্যাবাসনার নিমিত্তে ঘর ছাড়তে হলাে নাবালক বয়সে অবধারিত বিপত্তি এড়িয়ে, ডিঙিয়ে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক, পথেঘাটে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ। কলাভবন, বিশ্বভারতী, শান্তিনিকেতন, ভারত থেকে তন্তুকলা তথা বয়নচিত্র ও ভাস্কর্য (ট্যাপেস্ট্রি ও ফাইবার স্কাল্পচার) বিষয়ে স্নাতকোত্তর। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেছেন কয়েক বছর। বাংলার চারু-কারু অনুষঙ্গ নিয়ে তাঁর নিত্যভাবনার পাঁচালি, যার মধ্যে বাংলার বয়ন ও কারিগর পেশার অন্ত্যজদের নিয়ে সুলুকসন্ধানে বিশেষ উৎসাহী। ফলে এ সংক্রান্ত নিরন্তর গবেষণা লেখালেখি । তচর্চা, সন্তানদ্বয় ‘বয়ন’ ও ‘বৈভব’-এর যত্ন-আত্তি আর ‘টানাপােড়েন’ সংগত করা তাঁর নৈমিত্তিকযাপন নৈবেদ্যস্বরূপ। দীর্ঘ অভিবাসী জীবনে জীবিকার জন্য সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে ‘তকাজে ব্যাপৃত থাকলেও পড়া-লেখালেখির নিমিত্তে অসংখ্য শব্দরাশি নিয়ে নিত্যদিনের কাটাকুটি। লেখেন মূলত শিল্পকলা বিষয়ে, তবে সংখ্যায় বেজায় কম চিন্তায় কোনাে গুরুনির্দেশ বা বিধিবিধান খাটে না। সঠিক মাত্রায় বাঁধবার আয়াসে বরং বােধ ও প্রাণের ফজিলত শিল্পায়তে নাজিল হয়। প্রকাশিত পুস্তকাদি ‘শিল্পমনীষা’ (২০০১), ‘তদ্ভুকলা ও ট্যাপেস্ট্রি’ (২০০৪), ‘পরনকথা নগরদাইর’, ‘ভিঞ্চি নােটস্’, ‘শিল্পদর্শন’ (২০১০), তন্তুবায় স্বরূপ সন্ধান (২০১৪), ‘মানুষ ভজে রং তুলিতে, ‘শিল্পবয়ান' (২০১৯)। ফসলের আদিম শরীর থেকে বুনাে আমােদে গন্ধ-ছডানাে আরণ্যক গ্রাম বুকে নিয়ে পথিবীর নানা শহরে-গঞ্জে পিঠ ঠেকিয়েছেন বিবিধ ওসিলায়। গত দেড়দশক ধরে শিল্পী শফিকুল কবীর চন্দন ইউরােপ-অভিবাসী। দীর্ঘ একটা সময় কেটেছে উত্তর-ইতালির মিলান শহরে। সার্বক্ষণিক তন্তুশিল্পী হিসাবে বর্তমানে ইংল্যান্ডের লাফবরা শহরে স্ত্রী ও দুই পুত্রসন্তান নিয়ে বসবাস। বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের বয়ন ঐতিহ্যের প্রাণভূমি নরসিংদী জেলার এক ছােট সবুজ গ্রামে একদা জন্ম ও বেড়ে ওঠা ছেলেটি আজ পাশ্চাত্যে তাঁতে পােড়েনের রঙে, নকশায়, বুননে হাজির করে স্মৃতি ছবির মগ্নতা।