"গণিতের রহস্যপুরী" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ পেশা হিসেবে নয়, নেশা হিসেবে অঙ্ক নিয়ে মুষ্টিমেয় যে কয়জন লেখক বাংলাদেশে হালে ব্যাপৃত, জনাব এ.কে. বজলুল করিমের নাম তন্মধ্যে অবশ্যই বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। অঙ্কের বিষয় ফলাও করে লেখার হাত তার অনেক দিনের। তাই এ ধরনের একটা অবসর বিনােদনের বই তাঁর কাছ থেকে পাব বলে আমরা আশা পােষণ করে আসছিলাম। বইটি পেয়ে আমাদের সে অভিলাষ পূর্ণ হলাে। ইতিপূর্বে তাঁর লেখা অন্য এক বই ‘Alice in Numberland' সুধী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এ লেখাগুলােও অধিকাংশই বাংলাদেশ বেতার’-এ পড়া হয়েছে এবং বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কেননা, বিপুল সংখ্যক শ্রোতা সংশ্লিষ্ট ‘Quiz Programme'-এ আগ্রহ সহকারে সাড়া দিয়ে থাকেন। বলতে গেলে, জনাব করিমের ব্যক্তিত্ব দুই বিপরীত কর্মকাণ্ডের সমন্বয়। আমরা চিরকাল শুনে এসেছি, যারা সাহিত্যে ভালাে তারা নাকি ‘অঙ্কে দুর্বল হয়ে থাকেন। জনাব করিম চিরন্তনের সে ধারণাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে দিয়ে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. হয়েও অঙ্ককেই অবসর যাপনের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন। বেয়াল্লিশ পর্বে সাজানাে বইটির বিষয়গুলাে প্রায় সব ক'টাই গল্পের আকারে সাজানাে। ফলে, অনেক জটিল তথ্যও সহজবােধ্য হয়ে উঠেছে এবং এতে অনেকের মধ্যেই অঙ্কের আগ্রহ সৃষ্টি হবে। উদাহরণস্বরূপ, “এক, দুই, তিন...” শীর্ষক প্রথম পরিচ্ছেদটির কথাই ধরুন। এক-দুই-তিন সংখ্যাগুলাে দেখতে কত সহজ-সরল মনে হয়। অথচ যুগের পর যুগ কেটে গেল, আমরা কেউ কোন দিন লক্ষই করলাম না যে, এ সরলতম সংখ্যামালা আশ্চর্যতম সমন্বয়ে সাজতে পারে। জনাব এ.কে. বজলুল করিমই তা দুনিয়ার মানুষকে সর্বপ্রথম দেখালেন : ১ ২ = ৩ ৪ ৫ ৬ = ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২= ১৩ ১৪ ১৫ ১৬ ১৭ ১৮ ১৯ ২০ = ২১ ২২ ২৩ ২৪ এবং ধাপে ধাপে এ ধারায় অনন্তকাল পর্যন্ত; তবু প্রতি ধাপে ডানে-বাঁয়ে দু’দিকে স্বাভাবিক ক্রমিক সংখ্যাগুলাের (Natural Numbers) সমষ্টির সমান হওয়া থামবে না। নিঃসন্দেহে জনাব করিমের এটি একটি মৌলিক আবিষ্কার এবং পূর্ণ সংখ্যা-ঘটিত গণিতশাস্ত্রে (Theory of Numbers) এক গুরুত্বপূর্ণ সংযােজন। এ ছাড়াও আরও অনেক খুঁটিনাটি তথ্য তিনি বইখানিতে পরিবেশন করেছেন, যা সাধারণত কেউ লক্ষ করে না। অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে হয়, মি. করিম আবিষ্কার করেছেন, এক নাগাড়ে ক্রমিক সংখ্যাগুলাের বর্গের যােগফল কীভাবে দু’দিকে সমান হয় এবং সেও আবার বছরের দিন-সংখ্যা ৩৬৫-এর সমান হয়ে। যেমন ১০২ ১১২ ১২২ = ১৩২ ১৪২ = ৩৬৫; অবশ্য এটি তাঁর আর একটি গবেষণার অংশবিশেষ মাত্র, যার সংক্ষিপ্তসার ইতিপূর্বেই বিলেতের ‘Mathematical Gazette' পত্রিকায় (ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১) প্রকাশিত হয়েছে। | সরাসরি অঙ্কের কথা ছেড়ে দিয়ে এবার আসুন ইতিহাস পাঠে। দেখবেন, এখানেও অঙ্কের শাবল চালিয়ে জনাব করিম প্রমাণিত করেছেন, কেন পলাশীর যুদ্ধ ঈদুল-ফিতরের দু-চারদিন বাদে সংঘটিত হয়েছিল। সম্ভবত সুপ্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকেরাও এ যােগাযােগটা লক্ষ করেননি। অথচ মি. করিমের যুক্তিটা ফেলে দেবার নয়, বেশ বাস্তবানুগ এবং প্রণিধানযােগ্য। রামানুজন'-এর যে কাহিনীটি লিপিবদ্ধ করা হয়েছে সে-ও রীতিমতাে। নাটকীয়। অথচ আমরা এতই হতভাগ্য যে—এ উপমহাদেশেরই এক জাদুকরি প্রতিভা দারিদ্র্যের কষাঘাতে সুচিকিৎসার অভাবে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন সে খবরটুকুও পর্যন্ত আমরা রাখি না। অঙ্ক দিয়ে Decode করার কায়দাটা একবার যে শিখেছে, সে কখনাে অঙ্ককে ভুলতে পারবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস। কায়দাটি শুধু ছেলেমেয়েদের কেন বয়স্কদেরও ডিটেকটিভি অনুসন্ধানে ভাবিয়ে তুলবে। বইটির আরম্ভ যেমন, উপসংহারও তেমনি দার্শনিকসুলভ প্রশ্ন দিয়ে আরম্ভ, প্রশ্ন দিয়ে শেষ— মাঝখানে জীবনটা একটা বিরাট জিজ্ঞাসা চিহ্নের (?) মতাে সপ্তর্ষিমণ্ডলের আকারে আমাদের মাথার ওপর ঝুলছে। তাই গণিত বলুন, কাব্য বলুন, ইতিহাস বলুন, যােগবিয়ােগ করে এ অনিশ্চয়তার সংসারে কিছুতেই সঠিক যােগাযােগে আসা যায় না। তাই উপসংহার পর্বের যােগাযােগ নামকরণ বেশ সার্থক হয়েছে বলেই আমরা মনে করি। বইটির আমরা বহুল প্রচার কামনা করি এবং বিষয়গুলাে প্রধানত ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্যে লেখা হলেও বড়দেরও কম আনন্দ দেবে না বলেই আমাদের বিশ্বাস।