রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতাগুলির পরেই রবীন্দ্র-প্রতিভার বিশেষ প্রকাশ হিসাবে তাঁহার ছোটগল্পগুলির স্থান। বিচিত্র প্রকৃতির বহু নাটক তিনি লিখিয়াছেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো সেই সব নাটকের কোন কোন পর্যায়, যেমন কাব্যনাট্যগুলি, তাঁহার গান ও কবিতার পরেই বা সঙ্গেই সমান অমরতার আসন দাবি করিবে; ছোটগল্পগুলি তেমন আসন পাইবে কি না জানি না। কেননা, সাহিত্যিক ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা যায় যে, পদ্যের পরমায়ু গদ্যের চেয়ে বেশি। কিন্তু সেই শেষ বিচারের কথা এখানে মুলতুবি রাখিয়াও অনায়াসে বলা যায় যে, ছোটগল্পগুলিতে রবীন্দ্র-প্রতিভার বিশেষ ধর্ম যেমন প্রকাশ পাইয়াছে, এমন তাঁহার সব নাটকে নয়। তাঁহার প্রথম বয়সের অনেক নাটক, যেমন রাজা ও রানী এবং বিসর্জন, শিল্পসৃষ্টি হিসাবে অমূল্য হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্র-প্রতিভার বিশেষ প্রকাশ নয়, তাহাতে তিনি তৎকালপ্রচলিত পঞ্চাঙ্ক ট্রাজেডির ধারাকেই অনুসরণ করিয়াছেন। কিন্তু ছোটগল্পের ক্ষেত্রে এরকম স্বধর্মবহির্ভূত পদক্ষেপ নাই বলিলেই হয়, কেবল প্রথম বয়সে রচিত তিনটি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে তাহাদের পদাঙ্কের নীচে অস্পষ্টভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের পদচিহ্ন যেন চোখে পড়ে। কিন্তু সে তিনটিকে ছাড়িয়া দিলে, যখনই তিনি ছোটগল্পের ক্ষেত্রে পৌঁছিয়াছেন, একেবারে স্বক্ষেত্রে পদার্পণ করিয়াছেন, অপরের জমিতে আধিচাষ করিয়া রাজস্ব যোগাইবার দায় বহন করেন নাই। শুধু তাই নয়, সেই হইতে জীবনের শেষ পর্যন্ত ছোটগল্পের ধারা বহন করিয়া আসিয়াছেন; আরও দেখিতে পাইব যে, সে ধারা তাঁহার গান ও কবিতার ধারার সঙ্গে সমান্তরালতা রক্ষা করিয়া প্রবাহিত হইয়াছে। সেইজন্যই দেখিতে পাইব যে, তাঁহার সুদীর্ঘ জীবনে যে সব পরিবর্তন ও ছায়ালোকপাত ঘটিয়াছে, সে সমস্তই চিহ্নিত তাঁহার ছোটগল্পগুলিতে। কাজেই, যে মাপকাঠিতে তাঁহার কবিতার বিচার করি সেই মাপকাঠিখানা ছোটগল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করিলে অন্যায় হইবে না, বরঞ্চ সুফল পাওয়া যাইবে বলিয়াই মনে হয়। সুফল পাওয়া যাক আর না যাক, সেইভাবে বিচার করিবারই আজ ইচ্ছা। কিন্তু সে কাজে নামিবার আগে বিচারের ক্ষেত্রটির সীমা-শরহদ্দ স্থির করিয়া তাহার সম্বন্ধে ধারণাটি পরিষ্কার করিয়া লইব । আমার আলোচনার বিষয় রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প। ছোটগল্প বলিতে এখন বুঝিতেছি, তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ গল্পগুচ্ছ, সে, গল্পসল্প ও তিনসঙ্গী। রচনাকাল ১৮৮৪ সাল হইতে ১৯৪১ সাল, অর্থাৎ কবিজীবনের সাতান্ন বৎসর কাল । '
প্রমথনাথ বিশী ( Pramathanath Bishi, ১১ জুন ১৯০১ - ১০ মে ১৯৮৫) একজন লেখক, শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক। তিনি ১৯৬২-৬৮ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই জুন নাটোর জেলার জোয়াড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার পরিবারে জন্ম। পিতা নলিনীনাথ বিশী ও মাতা সরোজবাসিনী দেবী, স্ত্রী সুরুচি দেবী। ১৯১০ সালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সেখানে এক নাগাড়ে সতের বছর অধ্যয়ন। মেধা, প্রখর বুদ্ধি, অধ্যয়ননিষ্ঠা, কবি-প্রতিভা ইত্যাদি গুণাবলির জন্য রবীন্দ্রনাথের স্নেহ লাভ। তিনি কেরী সাহেবের মুন্সী বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১০মে, ১৯৮৫ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।এছাড়াও প্রমথনাথ বিশী আনন্দ পুরষ্কার এ ভূষিত হয়েছেন ।