ভূমিকা বাল্মীকিকে আমাদের দেশে আদি কবি বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। সামান্য পাখির শোকে তাঁর মুখে নির্গত হল এক অপূৰ্ব্ব ছন্দোময় বাণী ! ব্রহ্মার আদেশে সেই ছন্দে তিনি রচনা করে গেলেন পবিত্র রাম-চরিত্র। বাল্মীকি বর্ণিত রামায়ণে রামকে দেখানো হয়েছে সত্যপরায়ণ, কর্তব্যনিষ্ঠ, দেশের আদর্শ রাজারূপে । পিতার কথায় যিনি বনে গমন করেন, স্ত্রীর উদ্ধারের জন্য যিনি সমুদ্র বন্ধন করেন, আদর্শ হিসারে সত্যই তিনি জনগণের নমস্য। এই পবিত্র রামায়ণ আজ জগতে ৪টি শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের মধ্যে স্থান পেয়েছে। অনেকের মতে রামায়ণের উত্তরকাণ্ডটি বাল্মীকির রচিত নয়। শেষের অংশটুকু জুড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তা এতই অপূর্ব্ব হয়েছে যে, পরবর্তী যুগের কোন এক কৰি আজ আর তাকে ভিন্ন করে দেখা যায় না। মূল রামায়ণ রচয়িতা কাব্যটিকে মিলনান্তক করেছিলেন। কিন্তু পরবর্ত্তী কবির বোধ হয় তা মনঃপূত হয়নি । তাই বর্তমানে রামায়ণ বিয়োগান্তক কাব্যের আকার প্রাপ্ত হয়েছে। আমরা শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক রাজশেখর বসু মহাশয়ের লেখা হতে কিছু অংশ উদ্ধৃত করলাম :— এ বিষয়ে “পূর্ব্বকবি অগ্নিপরীক্ষা করেই সীতাকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন, কিন্তু উত্তরকবি তাঁকে নির্ব্বাসিত এবং পরিশেষে চিরবিচ্ছিন্ন করেছেন। এ কি নিষ্ঠুরতা, না উৎকট আদর্শ প্রীতি ? আমার মনে হয়, উত্তরকবির উদ্দেশ্য মহৎ, তিনি আপাতনিষ্ঠুর উপায়ে রাম ও সীতার মর্য্যাদা বৃদ্ধি করেছেন। পূর্ব্বকবি অগ্নিপরীক্ষার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা উত্তরকবির মনঃপুত হয়নি, তিনি নিজের আদর্শ অনুসারে পুনর্ব্বার সীতার পরীক্ষা বিবৃত করেছেন। সীতার অগ্নিপরীক্ষার বৃত্তান্ত বোধ হয় কালিদাসেরও ভাল লাগে নি, তিনি রঘুবংশে শুধু এক লাইনে একটু উল্লেখ করেছেন, কিন্তু নির্ব্বাসন আর পাতাল প্রবেশের বিবরণ সবিস্তারে দিয়েছেন। বিধবা রাক্ষসীদের শাপের ফলেই রাম সীতাকে অশুভ নয়নে দেখেছিলেন—এই কথা লিখে কৃত্তিবাস রামের দোষ খণ্ডন করেছেন। তুলসীদাস অগ্নিপরীক্ষার বিবরণ অতি সংক্ষেপে সেরেছেন এবং সীতার নির্ব্বাসন ও পাতাল প্রবেশ একেবারে বাদ দিয়েছেন । শেষের অংশটি যে কারণেই লেখা হোক না কেন, তা আর আজ স্বতন্ত্র করে দেখার উপায় নেই । যিনিই এই উত্তরকাণ্ডের রচয়িতা হোন না কেন, তিনি যে কোন অংশে বাল্মীকি অপেক্ষা ন্যূন ছিলেন, একথা আমাদের মনে হয় না । কারণ, তা যদি হতো, তাহলে উত্তরকাণ্ডটি এমনভাবে মূল কাণ্ডের সঙ্গে ওতঃপ্রোতভাবে যুক্ত হতো না, তা পাঠকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়তোই পড়তো । রামায়ণের নায়ক-নায়িকা রাম আর সীতাকে নিয়ে ভারতবর্ষের প্রায় সমস্ত ভাষায় কিছু না কিছু আখ্যান রচিত হয়েছে এবং দিনের পর দিন তা আদরের সঙ্গে গৃহীতও হয়েছে। অনেক সময় এই সমস্ত আখ্যানের সঙ্গে মূল রামায়ণের কোনরকম সংযোগই নেই। এর থেকেই আমরা পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, রাম আর সীতার চরিত্র ভারতবাসীর কাছে কতখানি আপনার ! সীতার চরিত্র মধ্যে ভারতীয় নারীর এক শাশ্বত রূপ আমরা দেখতে পাই। ইতিহাসের পাতায় আমরা হিন্দু নারীকে দেখতে পাই স্বামীর সঙ্গে হাসতে হাসতে রাজ্য ছেড়ে বনে গমন করেছেন। কখনও বা তাঁরা মৃত স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় চিতায় প্রবেশ করেছেন। সতীধর্ম রক্ষার্থে তাঁরা প্রাণ বিসর্জ্জন দিয়েছেন। সীতার চরিত্রের মধ্যে আমরা সবকটি গুণেরই একত্র সমাবেশ দেখতে পাই। তাই বলে তাঁর কি কোন ব্যক্তিত্বই ছিল না? সীতার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ হয়েছে আযোধ্যাকাণ্ডে বনগমনের সময়৷ এছাড়া তিনি যদি সত্যই ব্যক্তিত্বশূন্যই হতেন, তাহলে রাবণ মুঠোর মধ্যে সীতাকে পেয়েও তাঁকে অশোকবনে রাখতে বাধ্য হতেন না । শেষকালে দ্বিতীয়বার তাঁকে পরীক্ষা দেবার কথা বলতে রুদ্ধ অভিমানে ফেটে পড়ে তিনি শপথ গ্রহণের পর পাতাল প্রবেশ করলেন। হয়তো যে প্রজাবৃন্দকে তিনি সন্তানের মত পালন করেছিলেন, সেই প্রজাবৃন্দই অকারণে তাঁর নিন্দাবাদ করাতেই এই অভিমান ফুটে উঠেছিল। এই অভিমান তাঁর রামের প্রতিও হতে পারে। যিনি সব কিছু জেনেশুনেও তাঁকে পুনরায় পরীক্ষার কথা বলেছিলেন । সীতাকে আর একবার আমরা দেখি রাম পরিত্যক্তা হয়ে একাকিনী অরণ্যমধ্যে ভ্রমণ করতে। কল্পনায় আমরা তাঁর তখনকার মানসিক অবস্থার কিছুটা আভাস পেতে পারি । যে কোন নারী এই অবস্থায় পড়লে তাঁর পক্ষে আত্মহত্যা করা বিচিত্র নয় ! কিন্তু এ ক্ষেত্রে সীতা আত্মহত্যা করলেন না । অনাগত শিশু সন্তানদের জন্য তিনি তখন জীবনধারণই করেছিলেন। এর থেকে প্রমাণ হয় না কি, তিনি রাণী হলেও নারী, আর সেই নারীত্বের চরম উৎকর্ষ—মাতৃত্বে ! রামায়ণের আর একটা বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে লক্ষ্মণের চরিত্রের মধ্য দিয়ে। তিনি এক অপূৰ্ব্ব সংযমী গুরুষ! শৌর্য্যে-বীর্য্যে তিনি রামের অপেক্ষা কোন অংশেই কম নন । কিন্তু জ্যেষ্ঠ ভায়ের জন্য তিনি সব কিছু পরিত্যাগ করে বনগমন করেছেন, শোকে রামকে সান্ত্বনা দিয়েছেন, বিপদে নিজের প্রাণ তুচ্ছ করে ছায়ার মত অনুসরণ করেছেন রামকে । জগতের ইতিহাসে এর জুড়ি মেলা ভার। রামায়ণ সমালোচনা করতে বসলে আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে ৷ তিনি যা বলে গেছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলেই মনে হয়। তিনি বলেছেন :— “রামায়ণ মহাভারতের যে সমালোচনা তাহা অন্য সমালোচনার আদর্শ হইতে স্বতন্ত্র । রামের চরিত্র উচ্চ কি নীচ, লক্ষ্মণের চরিত্র আমার ভাল লাগে কি মন্দ লাগে, এই আলোচনাই যথেষ্ট নয় । শুদ্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কিরূপভাবে গ্রহণ করিয়াছে । ”