"দুর্গেশনন্দিনী" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ‘দুর্গেশনন্দিনী’ তাঁর প্রথম সৃষ্টি হলেও কালের বিচারে তাে বটেই, বিষয়ে ও আঙ্গিকেও তা অভিনব ও অসামান্য। মানসিংহের ছেলে জগৎসিংহের সঙ্গে কতলু খাঁর রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কাহিনী বর্ণনার ভেতর দিয়ে তিনি যে-প্রণয়কাহিনী সৃষ্টি করেছেন তা সাহিত্যমূল্যে এখন ক্ল্যাসিক পর্যায়ে উন্নীত। দুর্গেশনন্দিনী তিলােত্তমা ও জগৎসিংহের প্রেম এই কাহিনীর মূল উপজীব্য হয়েও আয়েষার প্রেম উজ্জ্বলতর হয়ে ফুটে আছে। বাংলায় প্রথম রােমান্টিক উপাখ্যান হিসেবে 'দুর্গেশনন্দিনী’ পাঠকধন্য হয়ে আছে। মােগল ও পাঠানদের মধ্যে চলমান যুদ্ধের পটভূমিতে ত্রিভুজ প্রেমের এক অনুপম আখ্যান এখানে বর্ণিত হয়েছে। কতলু খাঁর মেয়ে অর্থাৎ রাজকন্যা আয়েষা যখন কারাগারে আটক রাজসিংহকে উদ্দেশ করে বলেন, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর’ তখন তিলােত্তমার প্রেমিকের প্রতি আয়েষার প্রেম আর চাপা থাকে না। সেই ১৮৬৫ সালে হিন্দু-মুসলমানের প্রেম যেভাবে বঙ্কিম প্রকাশ করেছেন, তাতে সাহস আছে। কিন্তু মুসলমান মেয়েকে হিন্দুর প্রণয়াকাক্ষী করে মুসলমান জাতিকে ছােট করেছেন— এরকম মন্তব্যে বঙ্কিম সমালােচিত হয়েছেন। কিন্তু প্রেম যে জাত মানে না— এই অমিয় বাণী আমরা তার এই উপন্যাস থেকে পেয়ে যাই। আর এও লক্ষ করি যে, আয়েষা জগৎসিংহের প্রণয়াকাক্ষী ছিলেন কিন্তু তিলােত্তমার হৃদয় থেকে তাকে কেড়ে নিতে চাননি বরং তিলােত্তমা ও জগৎসিংহের মিলনকে সহজেই মেনে নিয়েছেন। আয়েষার এই প্রেম সামাজিক বন্ধনের ঊর্ধ্বে। আয়েষার প্রেমময়ী চরিত্রের মহত্ত্ব এখানে প্রকাশিত। এ সম্পর্কে আহমদ শরীফের মন্তব্য উল্লেখ করা যায় : ‘আয়েষার মতাে চরিত্র বাঙলা সাহিত্যে এরপর আর সৃষ্টি হয়নি। এ নারী রত্ন, যথার্থ অর্থে। কিন্তু কথা সেটা নয়। ঐযে আমাদের-যে একটা পূর্বশর্ত আছে, পূর্বধারণা আছে, যেমন : ভদ্রলােকেরা দাসীসম্ভোগ করে, কিন্তু দাসেরা যদি স্ত্রী-কন্যার দিকে দৃষ্টি দেয় তাহলে সেটা মহা অপরাধ হয়ে ওঠে। এটাও ঠিক সেরকম ব্যাপারই হয়েছে। তারা ধরেই নিয়েছেন যে, মুসলমান বাদশাহর জাত; হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করা, উপভােগ করা, সম্ভোগ করা মুসলমানের ন্যায্য অধিকার, জন্মগত অধিকার। সেই মুসলমানের বাদশাজাদী, নওয়াবজাদী আয়েষা হিন্দুর প্রতি আকৃষ্ট হয়— এরকম কথা বঙ্কিমচন্দ্র যখন লিখলেন, তখন এই অশিক্ষিত মুসলমানদের ভয়ঙ্করভাবে আত্মসম্মানে বাধল। মর্যাদায় ঘা লাগল। (আবুল কাসেম ফজলুল হক সম্পাদিত বঙ্কিমচন্দ্র অর্ধশত জন্মবর্ষে’, বাঙলা উপন্যাস পরিষদ, ১৯৯০, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮)। ইতিহাসশ্রয়ী কাহিনীর মােড়কে বঙ্কিম যে-প্রণয়ােপাখ্যান রচনা করেছেন, তা পাঠকের কাছে আরাে কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রথমত এর ভাষা; সাহিত্যের ইতিহাসে এটি নতুন স্বাদ। প্রায় দেড়শ বছর আগের এই ভাষা আমরা এখনাে উপভােগ করি। বঙ্কিমচন্দ্রের রসবােধের পরিচয় পেয়েও আমরা ধন্য হই। কাহিনীবিন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের দক্ষতা তাে অতুলনীয়। বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যের বিচারে বঙ্কিমচন্দ্র সকল অর্থেই একজন অসাধারণ ও আদর্শ পুরুষ হিসেবেই সম্মানিত হয়ে আছেন। 'দুর্গেশনন্দিনী’ তাঁর অসামান্য সৃষ্টি। বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রের কূটকৌশল ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয়েও পাঠক বিস্মিত ও আনন্দিত না হয়ে পারে না। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলাসাহিত্যের একটি আলােচিত উপন্যাস। উপন্যাসের প্রকৃত রস খুঁজতে এখনও আমাদের বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে যেতে হয়— ‘দুর্গেশনন্দিনী’র মাধ্যমে যে-বঙ্কিমের অগ্রযাত্রা সূচিত।
Bankim Chandra Chattapadhyaya- জন্ম হয় বর্তমান উত্তর ২৪ পরগনা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঁঠালপাড়া গ্রামে। তারিখ ২৬ জুন, ১৮৩৮ অর্থাৎ ১৩ আষাঢ় ১২৪৫। চট্টোপাধ্যায়দের আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি পেয়ে কাঁঠালপাড়ায় আসেন এবং সেখানেই বসবাস শুরু করেন। রামহরির পৌত্র যাদবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র বঙ্কিমচন্দ্র। বঙ্কিমের পূর্বে তাঁর আরও দুই পুত্র জন্মান – শ্যামাচরণ ও সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বঙ্কিমের জন্মকালে তিনি সদ্য অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। জন্মের পর ছয় বছর বঙ্কিমচন্দ্র কাঁটালপাড়াতেই অতিবাহিত করেন। পাঁচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভর ভট্টাচার্যের কাছে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতেখড়ি হয়। শিশু বয়সেই তাঁর অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। বঙ্কিমের কণিষ্ঠ সহোদর পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “শুনিয়াছি বঙ্কিমচন্দ্র একদিনে বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করিয়াছিলেন।” যদিও গ্রামের পাঠশালায় বঙ্কিম কোনওদিনই যান নি। পাঠশালার গুরুমশাই রামপ্রাণ সরকার বাড়িতে তাঁর গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। বঙ্কিমচন্দ্রের রচনা থেকে মনে হয় তিনি রামপ্রাণের শিক্ষা থেকে বিশেষ উপকৃত হন নি। তিনি লিখেছেন, “সৌভাগ্যক্রমে আমরা আট দশ মাসে এই মহাত্মার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করিয়া মেদিনীপুর গেলাম।” ১৮৪৪ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পিতার কর্মস্থল মেদিনীপুরে আনীত হলে, সেখানেই তাঁর প্রকৃত শিক্ষার সূচনা হয়। মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনৈক এফ টিডের পরামর্শে যাদবচন্দ্র শিশু বঙ্কিমকে তাঁর স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানেও বঙ্কিম অল্পকালের মধ্যেই নিজ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হন। পূর্ণচন্দ্রের রচনা থেকে জানা যায়, বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে টিড সাহেব বঙ্কিমকে ডবল প্রমোশন দিতে উদ্যত হলে যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে তিনি নিরস্ত হন। ১৮৪৭ সালে টিড ঢাকায় বদলি হয়ে গেলে সিনক্লেয়ার তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন; তাঁর কাছেও বঙ্কিম প্রায় দেড় বছর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র পুনরায় কাঁটালপাড়ায় ফিরে আসেন। এইসময় কাঁটালপাড়ার শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে বঙ্কিম বাংলা ও সংস্কৃতের পাঠ নেন। বঙ্কিমচন্দ্র খুব ভালো আবৃত্তিকারও ছিলেন। সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামক সংবাদপত্রে প্রকাশিত বহু কবিতা তিনি এই বয়সেই কণ্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্য থেকে বিদ্যার রূপবর্ণন ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম্ কাব্য থেকে ধীরে সমীরে যমুনাতীরে কবিতাদুটি তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন। এছাড়াও পণ্ডিত হলধর তর্কচূড়ামণির কাছে এই সময় তিনি মহাভারত শ্রবণ করতেন। হলধরই তাঁকে শিক্ষা দেন - “শ্রীকৃষ্ণ আদর্শ পুরুষ ও আদর্শ চরিত্র”। এই শিক্ষা তাঁর পরবর্তী জীবনে রচিত নানা রচনাতে প্রতিফলিত হয়েছিল। কিছুকাল পরে ১৮৪৯ সালে হুগলি কলেজে ভর্তি হন। এখানে তিনি সাত বছর পড়াশোনা করেন। হুগলি কলেজ পড়াকালীন ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই সংবাদ প্রভাকরে কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কুড়ি টাকা পুরস্কার লাভ করেন। হুগলি কলেজ অধ্যয়নকালেই বঙ্কিমচন্দ্র কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা আরম্ভ করেন। পরবর্তীকালে তাঁর বহু রচনা এই দুই কাগজে প্রকাশিত হয়। হুগলি কলেজ ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় সব বিষয়ে বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে আইন পড়বার জন্য কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে জানুয়ারী মাসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তন করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের আইন বিভাগ থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরের বছর ১৮৫৮ সালে প্রথমবারের মতো বি.এ. পরীক্ষা নেওয়া হয়। মোট দশজন ছাত্র প্রথমবারে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। উত্তীর্ণ হয়েছিলেন কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু। তার বাবার মতো তিনিও সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টার পদে। সারা জীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে দুটি খেতাবে ভূষিত করে - ১৮৯১ সালে রায় বাহাদুর খেতাব এবং ১৮৯৪ সালে কম্প্যানিয়ন অফ দ্য মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্য ইন্ডিয়ান এম্পায়ার খেতাব। তবে সরকারি কর্মকর্তা নয় বরং লেখক এবং হিন্দু পুনর্জাগরণের দার্শনিক হিসেবেই তিনি অধিক প্রখ্যাত। শেষ জীবনে তাঁর স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তাঁর বহুমূত্র রোগ বেশ বেড়ে যায়। এই রোগেই অবশেষে তাঁর মৃত্যু হয়, এপ্রিল ৮, ১৮৯৪ (বাংলা ২৬ চৈত্র ১৩০০ সাল)