ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা এই খণ্ডের ৯টি গল্পের দুটি-“সন্তু” এবং “ঈদ”-ছাড়া বাকীগুলো অগ্রন্থিত আখতারুজ্জামান ইলিয়াস থেকেই নেওয়া। পূর্বোক্ত গল্প দুটি দৈনিক আজাদ পত্রিকার ছোটদের পাতা “মুকুলের মহফিল” থেকে সংগৃহীত। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত এই গল্প দুটিই ইলিয়াষের প্রাপ্ত গল্পগুলির সবচেয়ে পুরনো। কবি-গবেষক আব্দুল মান্নান সৈয়দ জানান যে, “শোষিত বকুল” নামে ইলিয়াসের আরেকটি গল্প বেরিয়েছিলো জ্যোতি প্রকাশ দত্ত সম্পাদিত ছোট ম্যাগাজিন পরিচয়-এ। সম্ভবত ১৯৬০-৬২ সালের কোনো এক সংখ্যায় বেরিয়েছিলো তা।কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এই পত্রিকার কোনো কপির সন্ধান মেলেনি।এই লেখাগুলির অধিকাংশই ইলিয়াস গ্রন্থকারে ছাপতে চাইতেন না; বস্তুত তিনি প্রবলতার বিরোধিতাই করতেন। কিন্তু মৃত্যুর পর লেখক আর তাঁর রচনার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করেন না। বেগানা হাতে পড়ে তারা যেমন বিভিন্নভাবে পঠিত এবং বিশ্লেষিত হয়, তেমনি লেখকও হয়ে যান একীভূত তাঁর পাঠকের সারিতে। অমরীরী অবয়বে পাঠকের কি সম্পাদকের কি প্রকাশকের কাতারে দাঁড়িয়ে লেখক অসহায়ভাবে দেখেন তাঁর লেখা নিয়ে পাঠকের/সম্পাদকের/প্রকাশকের মচ্ছব।জীবন মানুষের মস্তিষ্কে তিনি জারিত হন, আবার নতুন প্রাণও পান। এবং এভাবেই একাত্ম হন পাঠকের মননে।যে-কোনো প্রয়াত লেখকের মতো ইলিয়াসের ভাগ্যেও এমনটিই ঘটছে। তবে কালানুক্রমিক এইসব রচনা প্রকাশের অন্তত একটি গুরুত্ব আছে; আর তার হলো এ থেকে ইলিয়াসের বয়সের প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে লেখা, হেলা-ফেলা করে লেখা, আঙ্গিক শব্দচয়ন ইত্যাদি ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত সচেতন থেকে লেখা, ছোটদের ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা মাথায় রেখে লেখা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের লেখায় ইলিয়াসের মানসিক বিবর্তনের যে ধারা তারই একটি পরিচয় রচনাসমগ্রর এই ৪র্থ খণ্ডে পাওয়া যাবে। সূচিপত্র *সন্তু *ঈদ *বংশধর *তারাদের চোখ *অতন্দ্র *স্বগতমৃত্যুর পটভূমি *নিস্বাসে যে প্রবাদ *চিলেকোঠায় *পরিচয় *দেওয়ানা মদিনা *কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ *হেক্টর উপাখ্যান *সোহরাব ও রোস্তম *আবু হাসানের গল্প *ঝড় *ডেভিড কপারফিল্ড *হাতির পেটে লড়াই *টুনটুনি ও কুনোব্যাঙ *শিক্ষক নির্দেশিকা *মহানবীর কথা *বেগম রোকেয়া *নাটোর ঘুরে আসি *ঢাকার চিঠি *বই পড়ার আনন্দ *স্বপ্নে আমার জন্ম *বৃষ্টির পর *না *এলমজির জন্য শোক *হে নটরাজ এবার তোমার নাচন থামাও *শোকসংবাদ *ডিসেম্বরের বেলা *গান *ফাহিম *টুম্পারানী *ট্রয়ের রানী *আমার রোগ *টুম্পারানীর জন্মদিনে *সর্দার আর্জার ও বাঘের কবিতা *আলো ভেঙে ভেঙে পড়ে..... *হিপোক্রোটিসের শপথ *বেহেশতের কুঞ্জি *প্রাসঙ্গিক তথ্য
গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মামাবাড়ি। এই মাতুলালয়েই ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পূর্ণনাম আখতারুজ্জামান মুহম্মদ ইলিয়াস হলেও মঞ্জু ডাকনামেও তার পরিচিতি রয়েছে। পৈতৃক বাড়ি ছিলো বগুড়ায়, তাই বগুড়া জিলা স্কুল থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, যেখান থেকে তিনি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আগাগোড়া। জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক পদ থেকে শুরু করে মিউজিক কলেজের উপধ্যাক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরিচালক পদেও নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। কবিতার প্রতিও ঝোঁক ছিলো তার, লিখেছিলেন কয়েকটি কবিতা, তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কবিতা কখনো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ প্রকাশিত হয়। তার বাচনশৈলী সাধারণ পাঠকদের কাছে প্রথমদিকে বেশ খটমটে লেগেছিলো। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৭ সালে। এছাড়াও আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার আরেকটি উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’। আখতারুজ্জামান এর বই সমগ্র-তে মোট দুটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পগ্রন্থ ও একটি প্রবন্ধ সংকলন রয়েছে। ‘খোয়াবনামা’কে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা হলেও আখতারুজ্জামানের ইলিয়াসের ছোটগল্পগুলোও পেয়েছে সমালোচকদের প্রশংসা। তার রচনা বিশ্লেষণধর্মী। পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন বিধায় রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণ ছিলো স্বাভাবিক ঘটনা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর বই সমূহ-তে তাই স্বাদ পাওয়া যায় রাজনীতির, এবং তার লেখার মাধ্যমে সমষ্টি ও ব্যক্তিকে দিয়েছেন সমান মর্যাদা। মুক্তমনা এ লেখক ১৯৮৪ সালে ‘সাহিত্য শিবির’ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র এবং বাংলা সাহিত্যে বহুমাত্রিক অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কার পান। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি এই সৃষ্টিশীল লেখক ইহলোক ত্যাগ করেন।