প্রচ্ছদ : মজিবুর রহমান ভূইয়া স্বত্ব : আলে রাসূল পাবলিকেশন্স কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
প্রকাশকের কথা ভূমিকা অধ্যায়-১ ইমাম হাসান ও তাঁর বাইয়াত
অধ্যায়-২ কুফার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
অধ্যায়-৩ ইমাম মুজতবা এবং খেলাফত
অধ্যায়-৪ যুদ্ধের প্রস্তুতি
একটি বিরোধের প্রতিউত্তর দ্বিতীয় বিরোধ
অধ্যায়-৫ বাহিনীর সৈন্য ও তাদের গুণাবলি আহলে বাইতের অনুসারী সামন্তবাদের সমর্থক স্বার্থপরের দল খারিজি সন্দেহপ্রবণ লোকদের দল
অধ্যায়-৬ সেনাবাহিনীর শক্তি আমাদের আপত্তি মুসাইয়্যাব বিন নাজিহ ফাযারির আপত্তি ইবনে কুসাইবার বর্ণনা যিয়াদ বিন আবিহর বক্তব্য
অধ্যায়-৭ নেতা নির্বাচন আরেকটি ভুল ধারণার অপনোদন নেতা নির্বাচনে রাযী আলে ইয়াসিনের বিশ্লেষণ
অধ্যায়-৮ মাসকিন থেকে মাদায়েন কি ঘটেছিল মাদায়েনে? সেনা অধিনায়কদের সঙ্গে বৈঠক সন্ধিচুক্তির পূর্বে ইমাম মুজতবার খুতবা
অধ্যায়-৯ কিছু ঐতিহাসিক মূল্যায়ন যাহরির বর্ণনার বিশ্লেষণ
অধ্যায়-১০ সন্ধিচুক্তির শর্তসমূহ সাদা কাগজ সন্ধিচুক্তির শর্ত ও ধারাসমূহ শর্তগুলোর বিশ্লেষণ কোরআন ও সুন্নাহ্র অনুসরণ খেলাফত নাকি রাজতন্ত্র খেলাফতের ভবিষ্যৎ জনসাধারণের মধ্যে শান্তিশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হজরত আলী ইবনে আবু তালিবের অনুসারীদের নিরাপত্তা রাসূল (সা.)-এর আহলে বাইতের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র না করা হজরত আলী ইবনে আবু তালিবের বিরুদ্ধে নিন্দার প্রচলন না করা কুফার বাইতুলমাল
অধ্যায়-১১ সন্ধিচুক্তি : পরিণতি ও পরবর্তী প্রভাব
অধ্যায়-১২ সন্ধির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা
অধ্যায়-১৩ সন্ধির শর্তের সাথে মুয়াবিয়ার আচরণ
অধ্যায়-১৪ ইমাম হাসানের শাহাদত
প্রকাশকের কথা যাবতীয় প্রশংসা জগতসমূহের অধিপতি আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার, যিনি মানুষকে সুশৃঙ্খল জীবন বিধান দিয়ে সত্যের পথে আহ্বান করেছেন এবং সেই পথে অবিচল থাকার জন্য দিয়েছেন হেদায়েতের উৎস স্বরূপ রাসুল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতকে। অসংখ্য দুরুদ ও সালাম রাহমাতুল্লিল আলামিনের প্রতি, যাঁর থেকে প্রবাহিত হয়েছে কাউসারের নহর। বিনম্র আত্মসমর্পণ কায়েমুজ্জামান ইমাম মাহদী (আ.)-র প্রতি, যাঁর আগমনের প্রতীক্ষায় রয়েছে পথহারা কোটি কোটি মজলুম জনতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর শুভাগমনকে দ্রুত ত্বরান্বিত করুন। মানবজাতির ইতিহাসের শুরু থেকেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের জন্য র্নিধারণ করেছেন সুন্দর ও সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা, যা দ্বারা আদম সন্তান ফিরে পাবে হারানো জান্নাতের মালিকানা। জান্নাতের পথে পরিচালিত হওয়ার বিধানকে কার্যকর করার জন্য বিধানের পাশাপাশি তিনি আলোকবর্তিকা হাতে পাঠিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন পদবির প্রতিনিধি, যারা নিজেদের সর্বস্ব বিলীন করে মানুষকে ভালোবেসেছিলেন এবং হেদায়েতের পথে আহ্বান করেছিলেন। সালামুন আলা আদম থেকে শুরু করে খাতামুন নাবী (সা.) পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত ছিল। এরপর নবুয়তের ধারার প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মানুষের মধ্যে তৈরি হয় হতাশা, বিভক্তি, বিদ্বেষ এবং বিপথগামিতা। দলে দলে বিভক্ত হয়ে মানুষ নিজেদের মনগড়া ধর্মের আদতে সাজাতে থাকে নিজেদের আকিদাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। যা এক সময় বিজাতীয় লোকদের হাতে অবদমিত হয়ে ধর্ম থেকে মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করে অন্তঃসারশূন্য এক ভঙ্গু জাতিতে পরিণত করে দেয়। আর এর ফলাফল ভোগ করছে আজকের যুগের মুসলমানেরা, যারা তাদের আখেরাত, বিশ্বাস, দ্বীন ও দুনিয়াকে একদল দুনিয়ালোভী আলেমের মুখোশে জালিমের হাতে তুলে দিয়েছে। কিন্তু এমন কি হওয়ার কথা ছিল? ইসলাম যেখানে দাবি করে যে, তা একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান সেখানে এমন কেন হবে? যেখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কোরআনের মাধ্যমে ঘোষণা করেছেন, “আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে পূর্ণ করালাম।” (সুরা মায়েদা, আয়াত-৩) সেখানে সেই কিতাবের অধিকারী জাতির অবস্থা এমন শোচনীয় কেন হবে? এর কারণ একটাই, তা হল আল কোরআনের সাথে এর প্রয়োগকারীর অনুপস্থিতি। আইন বইয়ের আকারে লিপিবদ্ধ থাকার পরও কি প্রয়োগকারীবিহীন আইন কার্যকর করা সম্ভব? মোটেই না। আকল কখনও এ কথা মেনে নিতে পারে না। মুসলিম জাতির এই অগণিত ভাগে বিভক্তির কারণও এটিই। ঐক্যের জন্য কেন্দ্রের প্রয়োজন। অথচ আজকে ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা সকলেই অনুভব করছে ঠিকই কিন্তু কেউ ঐক্যের কেন্দ্রের বিষয়ে চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছেন না। আজকের মুসলিম বিশ্বে দ্রোহের যে দাবানল প্রতিনিয়ত জ্বলছে, তা এক যুগের বা এক শতাব্দীর আগুন নয়। বিভক্তির এই সুস্পষ্ট ধারা একদিন, এক বছর বা এক শতাব্দীতে হয়নি। বর্তমান সময়ে যদি মুসলিম জাতিকে স্বীয় পরিচয়ে উজ্জীবিত হতে হয়, তবে অবশ্যই এই শোচনীয় অবস্থার কারণ অনুসন্ধান একান্ত জরুরি। তাই প্রয়োজন সাহসি কিছু মানুষের যারা ইতিহাসের বেড়াজাল থেকে সত্যের আলোকে মানুষের সামনে প্রস্ফুটিত করে তুলবেন। একদল আত্মত্যাগী গবেষক একটি জাতির অমূল্য সম্পদ, যারা নিজেদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে হলেও জাতির পরিচয় তুলে ধরবেন। তাদের প্রচেষ্টা মানুষকে সর্বদা আলোর দিকে ধাবিত করবে। আমাদের এই বইটি (ইমাম হাসান ও খেলাফত) সেই প্রচেষ্টারই একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। আমরা মোটেই বলছি না যে, এটিই শেষ; বরং এটি একটি সুদীর্ঘ পথের যাত্রা মাত্র। যেখান থেকে শুরু হবে, সোনালী দিনের আগমনের সংগ্রাম। এখানে তুলে ধরা হয়েছে ইমাম হাসান ইবনে আলীর সংক্ষিপ্ত ও সংগ্রামী খেলাফতকালের ইতিহাস, যেখান থেকে ইসলামি আদর্শে নির্মিত সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়েছিল রাজতন্ত্রে। মূলত এই সংক্ষিপ্ত খেলাফতকালের পরই মুসলিম জাতির শাসনভার একদল কায়েমি স্বার্থপর গোত্রের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। যারা জনগনের কল্যাণের চাইতে নিজেদের শৌর্য-বীর্যের প্রতি আকৃষ্ট ছিল বেশি। কায়সার ও কিসরার বিলাশী জীবনযাপনকে যারা মানুষের অধিকার হরণের মধ্য দিয়ে পূর্ণ করেছিল। যারা ইসলামের গৌরবকে মুছে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, স্বার্থপরতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি। পরিচালকের ভূমিকা থেকে বিচ্যুত হয়ে যারা শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল আর ফিরিয়ে এনেছিল জাহেলিয়াতের সকল কুপ্রথা। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান যে রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন, তা কোনোভাবেই ইসলামি হুকুমতের সাথে খাপ খায় না। সেজন্যই ঐতিহাসিকগণ এই শাসনকে ইসলামি হুকুমতের অন্তর্ভুক্ত করেননি। প্রায় সকল ঐতিহাসিকই উমাইয়্যা খেলাফতের তীব্র সমালোচনায় মুখর ছিলেন। এর মধ্য দিয়েও কিছু তথাকথিত ঐতিহাসিক, যারা দরবারি ভাতায় দুনিয়া চালাতেন তাদের কলমের দ্বারা ইতিহাস বিকৃত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছিলেন। তাদের প্রয়াস জাতিকে এমনভাবে বিচ্যুত করেছিল, যার পরিণতি ভোগ করেছে সেই যুগ থেকে শুরু করে আজকের সময় পর্যন্ত। যদিও তার পূর্ব থেকেই মুসলিম উম্মাহর মধ্যে বিভক্তি ছিল স্পষ্ট। আর আজ তা নানান দল উপদলে পরিণত হয়েছে। সেই সুযোগে ইসলামের চিরশত্রুরা এর মধ্যে প্রবেশ করিয়েছে আকিদাবিরোধী মূলনীতি। প্রাত্যহিক ইবাদত থেকে শুরু করে, আধ্যাত্মিক ও শরীয়তের মৌলিক বিষয় থেকে উম্মাহকে বিচ্যুত করে বোধহীন একদল অসাড় মানুষের গোষ্ঠীতে পরিণত হওয়ার জন্য যারা দায়ী তাদের স্পষ্ট করা না গেলে কখনোই এই নিষ্পেষণ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। রাসুল (সা.)-এর নাতি, ‘খাতুনে জান্নাত’ মা ফাতিমা ও ‘বাবুল ইলম’ হজরত আলী ইবনে আবু তালিবের সুযোগ্য পুত্র ইমাম হাসানের সংক্ষিপ্ত খেলাফতকাল মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই গুরুত্ববহ। কারণ এই সময়ের ইতিহাসকে এড়িয়ে গেলে প্রকৃত সত্য উন্মোচন করা একেবারেই অসম্ভব। এই সময়ে উপস্থিত থাকা উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে যদি আলোচনা করা না হয়, তাহলে একদিকে যেমন বিকৃতির উৎস সম্পর্কে জাতি বেখবর থাকবে তেমনি অপরদিকে মূল সত্য রয়ে যাবে পর্দার আড়ালে। এই বইয়ে লেখক ইসলামি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় নিয়ে ঐতিহাসিক দলিলভিত্তিক আলোচনা করেছেন, যা আগামি দিনের গবেষকদের জন্য মাইলফলক হয়ে থাকবে। লেখকের অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আমাদের প্রার্থনা থাকবে, যাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার এই কাজকে কবুল করেন। লেখক এই বইয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করেছেন ইতিহাসভিত্তিক দলিলগুলোর নিরপেক্ষ পর্যালোচনা করার, যাতে মূল সত্য সম্পর্কে কোন দ্বিধা-দ্বন্ধ না থাকে। বাংলা ভাষাভাষীদের জন্য সম্ভবত এটিই প্রথম বই যেখানে এই বিষয়ের উপর বিস্তারিত ও ঐতিহাসিক তথ্য সংবলিত আলোচনা করা হয়েছে। পাঠকের প্রতি আমাদের সবিনয় অনুরোধ থাকবে, যাতে নিরপেক্ষ ও সত্যানুসন্ধানী মন নিয়ে বইটি অধ্যয়ন করেন। আর আমাদের প্রচেষ্টা তখনই সার্থক হবে, যখন এই বইয়ের সূত্র ধরেই সত্যের সন্ধানে এগিয়ে যাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই পথে কবুল করুন। বইটি দ্রুত প্রকাশ করতে গিয়ে অনিচ্ছাকৃত ভুলক্রটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার জন্য সুহৃদ পাঠক মহলের প্রতি অনুরোধ রইল। সেই সাথে বইটি কম্পোজ, প্রচ্ছদ ও সম্পাদনার সাথে সংশ্লিষ্ঠ সবাইকে আন্তিরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। ধন্যবাদান্তে প্রকাশক আলে-রাসুল পাবলিকেশন।
ভূমিকা যথাযোগ্য প্রশংসা কেবল তাঁরই, যিনি আপন কুদরতের দ্বারা সৃষ্টি জগতকে পরিচালিত করেন এবং যিনি জীবন ও মৃত্যুর মালিক। দরুদ ও সালাম রাসূল (সা.) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি, যাঁরা নিজেদের সকল কিছুকে উৎসর্গ করে মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রচেষ্টা করেছেন। বিনম্র সালাম ও দরুদ ইমামে জামান (আ.)-এর প্রতি, যিনি আজও মানুষের সঙ্গে আল্লাহর স¤পর্ক উন্নয়নে ব্যস্ত। আল্লাহ তাঁর আগমনকে দ্রুত ত্বরান্বিত করুন। একটি জাতির পরিচয়ের পূর্ণতা মিলে সেই জাতির ইতিহাসে। যে জাতির ইতিহাস যত স্বচ্ছ, সে জাতি পৃথিবীর বুকে তত বেশি মর্যাদাবান। কারণ ইতিহাস আগামীদিনের পরিকল্পনা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখে। অতীতের ভুল জাতিকে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয় আর সফলতা লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়পদ রাখে। সেজন্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আল কোরআনে অসংখ্য স্থানে পূর্বের জাতিদের ইতিহাস টেনে এনেছেন, তাদের ভুল, অপরাধ, অবহেলা এবং সেগুলোর প্রভাব ও ফলাফল মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সেই সঙ্গে সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় বলে দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে আজকের যুগেও ইতিহাস পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ণয়ের কোনো বিকল্প নেই। আমরা এখানে ইতিহাসের কিছু সত্য ঘটনা নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি, যেগুলো ইসলামের ইতিহাসে পট পরিবর্তনের মাইলফলক। ইমাম হাসান ইসলামের ইতিহাসের এমন এক অধ্যায় যেখান থেকে ইসলামের নতুন নতুন ঘটনা ও দুর্ঘটনার যাত্রা হয়েছে। মূলত ইমাম হাসানের সংক্ষিপ্ত এই খেলাফতকাল ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই সময়ে বিগত দিনের রীতিনীতিকে উপেক্ষা করে একদল ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি নিজেদের মুখোশ উন্মোচিত করে বেরিয়ে এসেছিল। এই দলের লোকেরা প্রাক-ইসলামি যুগ থেকে শুরু করে খোলাফায়ে রাশেদার যুগ পর্যন্ত রাসূল (সা.)-এর সুপ্রতিষ্ঠিত ইসলামি হুকুমতের লাগাম নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়েছিল। এই সময়ে খেলাফত হস্তান্তরের চিরচেনা রীতি বিলীন হয়ে যায় এবং শুরু হয় ইসলামের নীতির বিরোধী গোত্রশাসন। ইমাম হাসানের খেলাফতের সমাপ্তির মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল বনু উমাইয়্যার খেলাফত। নেতৃত্বের বিষয়ে ইসলামের নীতি ছিল যোগ্যতা ও ধর্মভীরুতার ভিত্তিতে শাসনক্ষমতা বণ্টন করা। কোনো জনপদে নেতৃত্বের জন্য এতদিন যেমন লোকদের যোগ্যতা, আমানতদারিতা, সততা, কর্মের সচ্ছতার দ্বারা নেতা নির্ণয় করা হতো, এই সময়ে এসে সেই চিরচেনা প্রথার পরিবর্তে স্বজনপ্রীতি, গোত্র আধিপত্য, আমিরের নিকটবর্তিতা ইত্যাদি স্থান করে নেয়। ফলে বনু উমাইয়্যার সময়ে মুসলিম উম্মাহ তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে পরিণত হয় অন্তঃসারশূন্য একটি জাতিতে। আদর্শের ভিত্তি হারিয়ে গিয়ে উম্মাহর মধ্যে স্থান করে নেয় দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, আমানতের খেয়ানত, খুন, মিথ্যাচার, বেহায়াপনা। মূলত এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল রাসূল (সা.) কর্তৃক ঘোষিত খেলাফতের ক্ষেত্রে আহলে বাইতের অধিকার হরণের মধ্য দিয়েই। গাদিরে খুমের সেই ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো নেতা নির্বাচনের ফলে ইসলামের মৌলিক ভিত্তিতে যে আঘাত এসেছিল, সেই আঘাতেরই ফলাফল ছিল বনু উমাইয়্যার হাতে শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়া, যা থেকে আজও মুসলিম উম্মাহ পরিত্রাণ পায়নি। যদিও এখন বনু উমাইয়্যার শাসন নেই, তবে সুদীর্ঘকাল বিভিন্ন গোত্র ও রাজা-বাদশাহদের দুঃশাসনের ফলে মুসলিম উম্মাহ তাদের মৌলিক পরিচয় হারিয়ে এমন এক জাতিতে পরিণত হয়েছে যাকে পরিচিত করার মতো কোনো বিশেষত্ব এখন আর তাদের কাছে নেই। এই সকল আমির-বাদশাহ নিজেদের শাসনক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে কোরআনের ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে রাসূল (সা.)-এর হাদিস এবং ইতিহাসকে নিজেদের সুবিধামতো পরিবর্তন করেছে। দরবারি আলেমগণ তাদের বেতনভুক্ত হয়ে বাদশাহ বা আমিরদের ইচ্ছামতো ইসলামকে মানুষের সামনে ব্যাখ্যা করেছে। তৈরি করেছে জাল হাদিস এবং মিথ্যা ইতিহাসের গল্প। এই সকল মিথ্যা ইতিহাসের গল্পের মধ্যে অন্যতম একটি অধ্যায় হলো ইমাম হাসান ইবনে আলির খেলাফতের সময়কার ইতিহাস। পিতা আলী ইবনে আবু তালিবের শাহাদতের পর তিনি খেলাফতের অধিকারী হলেও সামান্য সময়ের শাসনামলে তিনি যেমন অভ্যন্তরীণ সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন, তেমনি ব্যস্ত ছিলেন সিরীয় বিদ্রোহীদের মোকাবিলা নিয়েও। সার্বিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির আলোকে এটা সহজেই বলে দেয়া যায় যে, তিনি স্বাভাবিক কোনো অবস্থায় খেলাফত গ্রহণ করেননি। সেই সময়ে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে সুস্পষ্ট দুটিভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান ইমাম হাসান অধিকৃত অঞ্চলের অধিকাংশ নেতাকে অর্থের বিনিময়ে ক্রয় করে নিয়েছিল, মিথ্যাচার ও অপপ্রচারের দ্বারা ইমামবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল, অকস্মাৎ আক্রমণের মাধ্যমে জনগণের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছিল। এভাবে উত্তপ্ত হয়ে পড়েছিল তখনকার সমাজব্যবস্থা। ফলে সবদিক থেকেই মুয়াবিয়ার সঙ্গে সন্ধির যৌক্তিকতা প্রবল আকার ধারণ করে। সময়ের চাহিদাই বলে দিচ্ছিল যে, এখন যুদ্ধের কোনো সম্ভাবনা নেই; বরং যুদ্ধ এনে দিতে পারে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। ফলে ইমাম হাসান সার্বিক পরিস্থিতি চিন্তা করে সন্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সন্ধির শর্ত নিয়েও ইতিহাসে আছে ব্যাপক ধূম্রজাল। বিভ্রান্তিমূলক তথ্য, সাক্ষী-প্রমাণ দিয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দেয়া হয়েছিল একটি সুস্পষ্ট বিষয়কে। অর্থ, সামাজিক ও রাজনৈতিক সুবিধা ও নিরাপত্তার আড়ালে লুকিয়ে ফেলা হয়েছিল সন্ধির পরবর্তী সময়ের ঘটনাগুলোকে। এই সন্ধি ইসলামের ইতিহাসের দিক পরিবর্তন করে দিয়েছিল। সন্ধির ফলে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ানের হাতে বনু উমাইয়্যার খেলাফত প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিবর্তিত হতে থাকে ইসলামের রীতি-নীতি, কোরআনের অনুশাসন ও সুন্নাহর অনুকরণ। সন্ধির সকল দিককে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছিল, যা আজও মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। কারণ শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষ দরবারি আলেমদের রচিত এই ইতিহাস জেনে এসেছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ইতিহাস চর্চা করেছে এবং এই শিক্ষার আলোকে গড়ে উঠেছে মুসলিম সমাজব্যবস্থা। বনু উমাইয়্যার পরও বনু আব্বাস থেকে শুরু করে সকল খেলাফত ও বাদশাহী বিকৃত এইসব ইতিহাসের চর্চা করেছে। এভাবেই বিনির্মাণ হয়েছে আলেম সমাজের মৌলিক ভিত্তি। ফলে কোনো প্রকার যাচাই-বাছাই, আকলের ব্যবহার, যৌক্তিক অনুসন্ধান ব্যতীত মানুষ অবলীলায় এই ইতিহাসগুলো চর্চা করেছে সেই বনু উমাইয়্যার যুগ থেকেই। এখন বলা যেতে পারে, তবে কেন সত্যপন্থিরা এর কোনো প্রতিবাদ করেনি বা এর বিরুদ্ধে জোর আন্দোলন গড়ে তোলেনি। তবে আমাদেরকে বলতেই হবে যে, ইতিহাস রচিত হয় বিজয়ীদের দ্বারা। যারা বিজয়ী হয়, তাদের সুবিধামতোই আইন রচিত হয়, শিক্ষাপদ্ধতি পুনর্গঠিত হয়, সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়। যখন দুঃশাসনের যাঁতাকল হাজার বছর ধরে মানুষের মন মগজ আত্মসাৎ করে রেখেছিল, জীবনের হুমকির মুখে, স¤পদ ও স্বজনদের নিঃস্ব হওয়ার ভয়ে সত্যের কণ্ঠ স্তিমিত হয়ে আসে। আজকের জালিম শাসকদের দিকে তাকালেই এ কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যাবে। মূলত সকল যুগেই জালিমদের নীতি ছিল এক ও অভিন্ন। তারা নিজেদের বিরুদ্ধে সকল প্রতিবাদী কণ্ঠকে দাবিয়ে রাখতে সদা প্রস্তুত ছিল। তবে এতসব গোঁজামিলের মধ্যেও অসংখ্য সত্য তথ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়। একদল ন্যায়পরায়ণ আলেম, যারা দরবারের অন্নে নিজেদের পেট ভরেনি, জালিমের তরবারির আঘাতকে তুচ্ছ গণ্য করেছিলেন এবং সত্য প্রকাশের দুর্বার সাহসী একদল লোকের কারণে আজও ইতিহাসে সত্য অটুট রয়েছে, যার দ্বারা কেয়ামত পর্যন্ত মানুষ হেদায়েতের পথ অনুসন্ধান করতে পারবে। আমাদের এই প্রয়াস সেই সকল সত্যপন্থি লোকদের জন্যই, যারা অন্ধকারের মেঘ সরিয়ে দিয়ে আলোর সূর্যের অপেক্ষায় দিন গুনে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। তাদের ধারাবাহিকতায় আমরা এই বইয়ে কিছু তথ্য সন্নিবেশিত করেছি। ইসলামের সত্য ও সহজ পথের সন্ধানীদের জন্য সম্ভবত এটাই বাংলা ভাষায় প্রথম বই যেখানে ইমাম হাসান ও তৎকালীন সময়ের খেলাফতের ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা তখনই সফলতার মুখ দেখবে, যখন পাঠক এই বইয়ের বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করবেন এবং সেই আলোকে সত্যসন্ধানী হবেন। আমরা মোটেই বলতে চাচ্ছি না যে, এটা সত্যের সন্ধান দিতে সম্পূর্ণ সক্ষম; বরং এটা একটি সুদূর লক্ষ্যে যাত্রার শুরু মাত্র। আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস থেকে আগামী প্রজন্ম তাদের গবেষণায় আরও অগ্রসর হবে, ইনশাল্লাহ।