বাংলা উপন্যাসের ধারায় নারী ঔপন্যাসিকেরা ধারাবাহিকভাবে বিশিষ্ট ও মৌলিক অবদান রেখেছেন। নারী ঔপন্যাসিকদের এই সমৃদ্ধ ধারায় নবনীতা দেবসেন শুধুমাত্র একটি উল্লেখযোগ্য নামই নন, সর্বার্থে ব্যতিক্রমী নামও বটে। তাঁর প্রতিভা বহুমুখী এবং কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ, রম্যরচনা, গবেষণামূলক প্রবন্ধ, ফিচার, স্মৃতিকথা সহ সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি সার্থক অবদান রেখেছেন। তাঁর উপন্যাসগুলিও চলতি ছকের নয়, সেখানেও তিনি বিষয় ও কাঠামোয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে মৌলিকতার স্বাক্ষর রাখতে চেয়েছেন। এই রচনাগুলি যেন একেকটি অনুপম গদ্যকবিতা । নবনীতার উপন্যাসগুলি পড়লেই বোঝা যায়, আসলে এগুলি এক কবির রচনা। মানবিক সম্পর্কের উষ্ণতায়, আবেগমথিত উন্মোচনের তীব্রতায়, প্রজ্ঞা ও অনুভবের গভীরতায়, শেকড়ের প্রতি নাড়ির টানে, দৃষ্টিকোণ ব্যবহারের বহুত্বে, আখ্যান-কৌশলের অভিনবত্বে, জীবনের নানা অপ্রত্যাশিত মোচড়ে নবনীতার নানা স্বাদের ন'টি উপন্যাসের এই সম্মেলন পাঠকের কাছে এক অনাস্বাদিত জগতের সন্ধান দিয়ে যায় । ‘প্রবাসে দৈবের বশে' উপন্যাসে দুই নিঃসঙ্গ নরনারী যৌনতার মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের শূন্যতার ক্ষতিপূরণ খোঁজে, দমচাপা স্মৃতির হাত থেকে মুক্তি খোঁজে, অতিক্রম করে যেতে চায় রাজনৈতিক ব্যর্থতা ও বাস্তবতার সীমাবদ্ধতাকে এবং রেখে যেতে চায় মানবিক সম্পর্কের শাশ্বত স্মৃতিকে। ‘স্বভূমি’ উপন্যাসে রয়েছে স্বভূমিকে ভালোবাসার কাহিনী । ‘একটি ইতিবাচক প্রেমকাহিনী' একটি প্রেম বিষয়ক গদ্যকবিতা । ‘সমুদ্রের সন্ন্যাসিনী” ও ‘বিষহরির প্রসাদ', এই উপন্যাস দুটিতে কিশোর অভিজ্ঞতার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ইতিহাস, মিথ ও রহস্য। 'রঙ্গিনীর রাজ্যপাট' কৈশোরের চোখ দিয়ে দেখা রহস্য উন্মোচনের কাহিনী। ‘অ্যালবাট্রস’য়ে রয়েছে যৌনতা ও মানসিক বিকারের কথা, উড়াল’য়ে রয়েছে মৃত্যু ও তাকে অতিক্রম করে যাওয়া মানবিক সম্পর্কের কথা। ‘রামধন মিত্তির লেন'তে এসেছে পাঁচ পুরুষের বাড়ি ভাঙাকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দ্বন্দ্ব। এই গ্রন্থটিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে নবনীতার রম্য কাহিনীর সংকলন 'জরা হটকে এবং অন্যান্যর সংযোজন, নিজেকে নিয়ে নানা কৌতুকে, বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতায় ও স্মৃতিতে যা সমৃদ্ধ হয়ে আছে। সবশেষে বলা যায়, নবনীতা দেবসেনের রচনার কেন্দ্রে রয়েছে একটিই বিষয়, মানুষ ও মানবিক সম্পর্কের প্রতি তৃষ্ণার্ত প্রেম, যা এই সংকলনের প্রতিটি পৃষ্ঠাকে উষ্ণ রেখেছে।
নবনীতা দেবসেন দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে তাঁর বাবা- মা'র 'ভালবাসা'(এখনো সেখানেই বসবাস করেন) গৃহে জন্মগ্রহন করেন । পিতা নরেন্দ্র দেব ও মাতা রাধারানী দেবী সেযুগের বিশিষ্ট কবি দম্পতি। ছেলেবেলায় এক বিশেষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া উনি হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাগুলি পড়তে পারেন। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস, লেডি ব্রেবোর্ণ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর , হার্ভার্ড, ইণ্ডিয়ানা (ব্লুমিংটন) ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। ১৯৭৫- ২০০২ তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তাকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট অথরিটি মানা হয়। যাদবপুরে তিনি কবি বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য ছাত্রী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সাহিত্য একদেমি পুরস্কার পান তার আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনা 'নটী নবনীতা' গ্রন্থের জন্যে। এছাড়াও তিনি মহাদেবী বর্মা ও ভারতীয় ভাষা পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৫৯ এ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' প্রকাশিত হয় ও প্রথম উপন্যাস 'আমি অনুপম' ১৯৭৬ এ। কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস মিলে তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩৮। এখনো নিয়মত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন। ১৯৬০ এ তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ (পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী) অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ও তাদের দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা অন্তরা সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং কনিষ্ঠা নন্দনা অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী।