সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহ (১৯২২-৭১) বিভাগপূর্বকালে বাঙালি মুসলমান কথাসাহিত্যিকদের পথিকৃৎ শিল্পী হিসেবে বিবেচিত। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ 'নয়নচারা' ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৯-৪৫ পর্যন্ত সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হয়। দুর্ভিক্ষ ও জীবনযুদ্ধের অভিঘাত গল্পগুলোতে ভাষারূপ লাভ করেছে। স্মতব্য চারুলিপি প্রকাশিত রচনাবলি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (ঢাকা, ২০১৫) থেকে আমি উদ্ধৃতিগুলো ব্যবহার করেছি। 'নয়নচারা: গল্পগ্রন্থ প্রকাশের প্রায় দু-বছর পর পরিচয় পত্রিকার 'পুস্তক পরিচয়' বিভাগে সুশীল জানার আলোচনায় তিনি ওয়ালীউল্লাহকে মনঃসমীক্ষণাত্মক বলেছেন। এ কারণে 'রচনা জীবন-ধর্মী না হয়ে, হয়ে পড়ে ভাবধর্মী' বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। আসলে ওয়ালীউল্লাহ সাধারণ মানুষের জীবনকে গভীরতম থেকে দেখতে চেয়েছেন বলেই প্রাকৃতিক-মানসিক ও সার্বিক পরিপ্রেক্ষিতের ভিত্তিতেই তার চরিত্রগুলোকে বিনির্মাণ করেছেন এবং সফল হয়েছেন বলে আমি মনে করি। 'নয়নচারা'র প্রকাশকাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির বছর। এ বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে জীবনের যে অর্থনীতিক দৈন্য ও দুর্ভিক্ষের করাল ছায়া-তা তীব্রভাবে নামগল্প 'নয়নচারা'য় অভিব্যক্ত হয়েছে। 'যনারমল কালো রাতে জনশূন্য প্রশস্ত রাস্তাটাকে ময়ূরাক্ষী নদী বলে কল্পনা করতে বেশ লাগে।'- ভাষ্যের মধ্যদিয়ে 'নয়নচারা' গল্পটি শুরু। আমু, ভূতনি, ভুতো এবং করিম মিঞা প্রমুখ চরিত্র নিয়ে গল্পটি রচিত। ভুতো খাদ্যাভাবে ও রোগভোগে মারা যায়। ভুতনি শুধু কাশে। অসুস্থ ও ক্ষুধার্ত। আমু ক্ষুধার তাড়নায় পর্যুদস্ত ও জীবনযুদ্ধে পরাজিত।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।