“তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৪৭-১৯৪৮-১ম খণ্ড" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ তাজউদ্দীন আহমদ-এর জন্ম ২৩ জুলাই ১৯২৫ সালে কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মুহাম্মদ ইয়াসিন খান এবং মা মেহেরুন্নেসা খানম। তাঁরা ছিলেন চার ভাই ও ছয় বােন। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারের সন্তান হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে, এরপর বাড়ি থেকে দুই কিলােমিটার দূরবর্তী ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে। চতুর্থ শ্রেণিতে উঠে তিনি ভর্তি হন দরদরিয়া থেকে পাঁচ মাইল দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলে। কাপাসিয়া এমই স্কুলে থাকার সময় দুজন প্রবীণ বিপ্লবী নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং তারা শিক্ষকদের কাছে এই ছাত্রকে আরও ভালাে স্কুলে পাঠানাের সুপারিশ করেন। সেই সুবাদে তিনি কালীগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। এই স্কুলেও তাঁর মেধা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং প্রধান শিক্ষকের পরামর্শে তিনি ভর্তি হন ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে এবং তারপর সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে। উল্লেখ্য, স্কুলে তাজউদ্দীন বরাবর প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছেন। তিনি এমই স্কলারশিপ পরীক্ষায় ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তাজউদ্দীন আহমদ পবিত্র কোরআনে হাফেজ ছিলেন। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থানের অধিকারী হন। ১৯৪৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ১৯৪২ সালে তিনি সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং নেন। এবং আজীবন বয়স্কাউট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ স্কুলজীবন থেকেই রাজনীতি তথা প্রগতিশীল আন্দোলন এবং সমাজসেবার সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। এ কারণেই তাঁর শিক্ষাজীবনে মাঝেমধ্যেই ছেদ পড়েছে এবং নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দেওয়া তার ভাগ্যে বড় একটা জোটেনি। কিন্তু তবু রাজনীতি ও শিক্ষা তার হাতে হাত ধরে চলেছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ার কারণে এমএ পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। এদিকে এমএলএ নির্বাচিত হয়েও তিনি আইন বিভাগের ছাত্র হিসেবে নিয়মিত ক্লাস করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে তিনি আইনশাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৩৫০-এর দুর্ভিক্ষে অগণিত মানুষের খাদ্যাভাবে মৃত্যুবরণ তাজউদ্দীনের মনকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী সময়ে তিনি উপলব্ধি করেন, খাদ্যাভাবে আর যাতে কেউ মারা না যায়, তার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন। গ্রামের লােকজনকে সংগঠিত করে স্থাপন করেন ধর্মগােলা’, যা ছিল গ্রাম পর্যায়ে অশ্রুত এক প্রতিষ্ঠান। ফসল ওঠার মৌসুমে ধনীদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য এনে ওই গােলায় জমা করা হতাে, যাতে আপকালে ক্ষুধার্তকে খাদ্য দেওয়া সম্ভব হয় । আর্তের সেবায় তার কোনাে ক্লান্তি ছিল না। ১৯৫৪ সালে তিনি যখন এমএলএ, তার গ্রামের সাইফুদ্দিন দফাদারের পুত্র আবদুল আজিজ (১৫) বন্দুকের গুলিতে আহত হয়। জনৈক হাসান ও অন্যদের মাধ্যমে তাকে ঢাকায় তাজউদ্দীনের কাছে আনা হয়। তিনি অ্যাম্বুলেন্সে করে ওই বালককে হাসপাতালে নেন। তার জন্য নিজে ১০ আউন্স রক্ত দেন। পরে ওই বালকের মৃত্যুর সংবাদ শুনে উদ্ভ্রান্তের মতাে হাসপাতালে যান এবং পােস্টমর্টেমের ব্যবস্থাদি করেন। এই মৃত্যু তাঁকে গভীরভাবে মর্মাহত করেছিল। ছাত্রজীবন থেকেই বাংলার মানুষের মুক্তির রাজনীতির সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের সম্পৃক্ততা ঘটে। ১৯৪৩ সাল থেকে তিনি তৎকালীন মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই এই পূর্বাঞ্চলের মানুষের মুক্তির পথানুসন্ধান শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে ভাষার অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী যত আন্দোলন হয়েছে, তাজউদ্দীন তার প্রতিটিতেই নিজ চিন্তা ও কর্মের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ (বর্তমান বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) গঠিত হয়; তিনি ছিলেন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষার প্রশ্নে যে বিক্ষোভ ও প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে ওঠে, তিনি ছিলেন তার সক্রিয় অংশী । ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ গঠিত হয় । তাজউদ্দীন ছিলেন এর মূল উদ্যোক্তাদের অন্যতম। ১৯৫৩-৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী।