শতবার্ষিকী সংকলনের আলােচনা নীহাররঞ্জন গুপ্তের জন্মশতবার্ষিকী সংকলনে অন্তর্ভুক্ত গ্রন্থগুলি এইরকম ভাবে বিন্যস্ত কালােভ্রমর চারটি পর্ব একত্রে, অস্তি ভাগীরথী তীরে, উত্তরফাল্গুনী, রাজকুমার ও বাদশা।এর মধ্যে ‘রাজকুমার’ নীহাররঞ্জনের প্রথম রচনা। তখন তার বয়স মাত্র ১৮, যখন তিনি কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজের (বর্তমান আর. জি. কর মেডিক্যাল কলেজ) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। কৃষ্ণনগর কলেজে আই এসসি পড়ার সময়ে যে সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন, মেডিক্যাল কলেজে পড়ার চাপে তাতে বাধা পড়ে যায়। মা লবঙ্গলতাই বলে বলে সে সাহিত্যের নেশা উত্সকে দিলেন। লেখা হল ছােটোদের উপন্যাস ‘রাজকুমার। ছােটোদের মাসিক ‘শিশুসাথী’তে ধারাবাহিক প্রকাশের পর আশুতােষ লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হল গ্রন্থাকারে প্রথম উপন্যাস ‘রাজকুমার। একটি গরিব ঘরের কাহিনী। মা ও পুত্র নিমাইকে নিয়ে তাদের জীবন কাটে। নিমাইয়ের বাবা সন্ন্যাস রােগে অকস্মাৎ মারা যাবার পর দুর্দশা শুরু হয় তাদের। অবশেষে উপায়ান্তর দেখে নিমাইয়ের মা তার আপন বােনের কাছে আশ্রয় নেন, নিমাইয়ের মাসীমার কাছে। তাঁরা নিমাইকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান। সাদরে আশ্রয় দেন তাদের। নিমাইয়ের মাসীমার কোনাে সন্তান ছিল না। তিনি নিমাইকে এত ভালােবেসে ফেলেন, অনুরােধ- উপরােধ করে বােনকে রাজী করিয়ে নিমাইকে দত্তক নেন। তার নতুন নাম হয় রাজকুমার। কিন্তু মাসীমামেসােমশাইকে ভালাে লাগলেও রাজকুমার নিজের মা-কে ভুলতে পারে না। আদরে যত্নে লালিত হলেও মানসিক ভাবে গুমরে থেকে থেকে রাজকুমার একদিন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হল। শেষে ডাক্তারবাবুর পরামর্শেই মাসিমা-মেসােমশাই রাজকুমার তথা নিমাইয়ের মাকে ডেকে আনালেন। তারপর নিমাই মাকে পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। নিমাইয়ের মেলােমশাইয়ের একটি কথা পরের ছেলেকে জোর করে কোনাে দিনও আপন করা যায় না। পরকে আপন করতে হলে তাকে সময় দিতে হয়।এই বাক্যটির মধ্যেই কাহিনীর সার সত্য নিহিত আছে। সতেরাে-আঠারাে বছরের এক নবীন যুবকের হাতে কাহিনী-বয়নের এই ধরনের মুন্সিয়ানা অবশ্যই অকুণ্ঠ প্রশংসা দাবি করে।এর পরের গ্রন্থই ‘কালােভ্রমর। কালােভ্রমর ১ম পর্ব সুব্রত, রাজু, সুব্রতর পরম বন্ধু নীতীশ এবং সনৎ-এর কাহিনী। সেই সঙ্গে অ্যাটনী অমর বসুর কর্ম-তৎপরতারও কাহিনী। কালােভ্রমর ১ম পর্বে কিন্তু কিরীটীর আবির্ভাব ঘটেনি। কিরীটীর আবির্ভাব দ্বিতীয় পর্বে। যখন সুব্রতর বাড়িতে গৃহপ্রবেশ উপলক্ষে আয়ােজিত প্রীতিভােজে কিরীটী রায় আমন্ত্রিত হয়েছে। তার কিছুদিন পরেই, সনৎ-এর উপর কালােভ্রমরের আক্রমণ। কিরীটী পেশাদার গােয়েন্দা ছিল না। সব্রতর সঙ্গে পরিচয় এবং সুব্রত ও সনৎ-এর উপর কালােভ্রমরের প্রতিহিংসাই তাকে রহস্যভেদী ও গােয়েন্দা করে তুলল। নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত আর ব্রহ্মদেশ থেকে রাঁচী পর্যন্ত নানা অভিযানের মধ্য দিয়ে উদঘাটিত হল কালােভ্রমরের আসল পরিচয়। প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার সান্যালই কালাে ভ্রমর। বিপথগামী হয়ে কী করুণ পরিণতিতেই না শেষ হল তার জীবন। এইখানে কিরীটীর চরিত্রের এক মহৎ দিক উন্মােচিত হয়েছে। ফাঁসির দড়ির পরিবর্তে, যত অপরাধই করে থাকুক কালােভ্রমর, কালােভ্রমর তার নিজের জীবন নিজেই শেষ করুক। নীহাররঞ্জনের ১৯ বছর বয়সে কালােমর ১ম পর্ব প্রকাশিত হয়। তারপর চিকিৎসাবিদ্যার স্নাতক কালের মধ্যেই কালােভ্রমরের আরও তিনটি পর্ব প্রকাশিত হয়।
বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটি রায় এর স্রষ্টা এবং জনপ্রিয় রহস্য কাহিনী লেখক ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত শুধু একজন সাহিত্যিকই ছিলেন না, একইসাথে ছিলেন একজন চিকিৎসকও। একজন ভারতীয় বাঙালি সাহিত্যিক হিসেবে দুই বাংলাতেই লাভ করেছেন বিশেষ পাঠকপ্রিয়তা। ওপার বাংলায় বেড়ে ওঠা ও জীবন কাটালেও তিনি জন্মেছিলেন এপার বাংলায়। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় ১৯১১ সালের ৬ জুন বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয় পরিবারের সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন এই প্রখ্যাত কাহিনীকার। পিতার বদলির চাকরির সূত্রে বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করতে হয়েছে । শেষ পর্যন্ত কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ও কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করার পর তিনি কলকাতার কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন ও চর্মরোগ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন লন্ডন থেকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে তিনি ডাক্তার হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন দেশের রণাঙ্গনে ঘুরে ঘুরে সেবাদানের পাশাপাশি বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, যার ছাপ পরবর্তীতে পড়েছে নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমূহতে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই লেখার ইচ্ছা ছোটবেলা থেকেই এবং সেই সূত্রে তিনি অনেক কম বয়সেই তাঁর প্রথম উপন্যাস 'রাজকুমার' রচনা করেন। তবে নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাস এর মধ্যে তাঁকে আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে তাঁর লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস সমূহ, যা রচনা করার আগ্রহ থেকে তিনি ব্রিটেনে অবস্থানকালে সাক্ষাৎ করেন আরেক বিখ্যাত গোয়েন্দাকাহিনী রচয়িতা আগাথা ক্রিস্টির সাথে। নীহাররঞ্জন গুপ্তের গোয়েন্দা গল্প এর মধ্যে প্রথমটি হলো 'কালোভ্রমর', যেখানে তিনি সকলকে পরিচয় করিয়ে দেন তাঁর সেরা সৃষ্টি গোয়েন্দা কিরীটি রায়ের সঙ্গে। এছাড়াও নীহাররঞ্জন গুপ্তের রচনাবলী এর মধ্যে 'মৃত্যুবাণ', 'কালনাগ', 'উল্কা', 'হাসপাতাল', অপারেশন', 'কিরীটি অমনিবাস' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বই এর সংখ্যা প্রায় দুই শতাধিক। আর নীহাররঞ্জন গুপ্ত এর বই সমগ্র এর মধ্যে প্রায় ৪৫টি নিয়ে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এছাড়াও তিনি 'সবুজ সাহিত্য' নামে শিশু-কিশোর উপযোগী সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিখ্যাত সাহিত্যিক ৭৪ বছর বয়সে ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।