শব্দ এবং অনুভূতির দ্রোহে গল্পের কাঠামো নির্মাণ করেন, বাংলা সাহিত্যের অনন্য কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন। তিনি কেবল গল্প লেখেন না, গল্পের আখ্যানে বুনে দেন বাঙালি চেতনার সৌরগ্রাম। তাঁর সাম্প্রতিকতম গল্পগ্রন্থ নুন-পান্তার গড়াগড়ি। বইটিতে জায়গা পেয়েছে পনেরটি গল্প। প্রত্যেকটি গল্প চেতনার রক্তজবায় মোড়ানো। চিলির বিপ্লবী কবি পাবলো নেরুদা’র জীবনের আখ্যানের গল্প ‘নেরুদার কবিতা’ শেষ পর্যন্ত পৃথিবীর প্রান্তিক দলিত আর লড়াকু মানুষদের ন্যায়সংগত লড়াইয়ের আশ্চর্য হাতিয়ার হয়ে ওঠে। ‘মৃত্যুর সূত্র কী’ গল্প ময়মনসিংহ অঞ্চলের আদিবাসীদের লড়াই, বেঁচে থাকার আর্তি ও দমন পীড়নের বিরুদ্ধে শব্দের শিল্পিত কারুকাজ। আমাদের মানবিক সম্পর্ক কতো ঠুনকো, স্বার্থের সুই-সুতোয় আমরা কতোটা আবদ্ধ, তারই শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাপন ‘ভাঙনের শব্দ’ গল্প। প্রান্তিক বাঙালির জীবন- নুন-পান্তার জীবন। একজন আরজ আলী; শিক্ষক স্কুলের, বেতন দিতে না পাড়ায় মেয়ে কৌমার্য হারিয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি এসেছেন ঢাকায়, বেতন বাড়ানোর মিছিলে, পুলিশ রাজপথে ফেলে বুকের উপর রেখেছে বুট, নুন-পান্তার নির্মম গড়াগড়িতে ডুবে যায় চোখ, ডুবে যায় আবহমানকালের শিক্ষা এবং সমগ্র বাংলাদেশ। দরদ আর কাঠিন্যের কালিতে লেখা সেলিনা হোসেনের দগ্ধ মনের ক্ষুধিত গল্প ‘নুন-পান্তার গড়াগড়ি’। গোবরা মিয়া ‘ক্ষতিপূরণ’ গল্পের চরিত্র। জেলখাটা মানুষ দীর্ঘবছর বিনাকারণে জেল খেটে মুক্ত হয়েছে। চাইছে যৌবনের ‘ক্ষতিপূরণ’। কার কাছে? যে আইন তাকে বন্দি রেখেছে, সেই আইন তাকে ক্ষতিপূরণ দেবে? এভাবে মানবজীবনের নানা অনুষঙ্গ চিত্রিত হয়েছে বইয়ের অন্যান্য গল্পে। সেলিনা হোসেনের গল্প মানে চেতনার ইতিহাস, ভূগোলের প্রকৃতি, সুন্দর ও অসুন্দরের লড়াই, জল ও কাদার মতো মিশে থাকার পানপাত্র। পাঠক কেবল গল্প-ই পাঠ করেন না, পাঠ করেন জীবনবোধ নিংড়ানো ক্যানভাস।
২১টি উপন্যাস, ৭টি গল্পগ্রন্থ ও ৪টি প্রবন্ধগ্রন্থের রচয়িতা সেলিনা হোসেন বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক। সমকালীন রাজনৈতিক সংকট ও দ্বন্দ্বের উৎস ও প্রেক্ষাপট উঠে এসেছে সেলিনা হোসেন এর বই সমূহ-তে। সেলিনা হোসেন এর বই সমগ্র অনূদিত হয়েছে ইংরেজি, রুশসহ একাধিক ভাষায়। প্রবীণ এ লেখিকা ২০১৪ সাল থেকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর কর্মজীবন থেকে অবসর নেন। সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। আদি পৈতৃক নিবাস নোয়াখালীতে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকা হয়নি তার। চাকরিসূত্রে তার বাবা রাজশাহী চলে এলে সেটিই হয়ে ওঠে সেলিনার শহর। স্থানীয় এক বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে রাজশাহী মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ছোটবেলা থেকেই সাহিত্য পড়তে ভালোবাসতেন তিনি। আর ভালোবাসার টানে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ১৯৭০ সালে বাংলা একাডেমির গবেষণা সহকারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন সেলিনা হোসেন। এরপর সরকারি কলেজে শিক্ষকতা এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনেও কাজ করেছেন তিনি। পাশাপাশি পত্রপত্রিকার জন্য চালিয়ে গেছেন তার কলম। টানা ২০ বছর তিনি ‘ধান শালিকের দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সেলিনা হোসেন মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস রচনা করে পাঠকমনে চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। তার রচিত মুক্তযুদ্ধ বিষয়ক কালজয়ী উপন্যাস ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’ নিয়ে তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ‘যাপিত জীবন’, ‘ক্ষরণ’, ‘কাঁটাতারে প্রজাপতি’, ‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’, ‘যুদ্ধ’, ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ (তিন খণ্ড) ইত্যাদি তার জনপ্রিয় উপন্যাস। ‘স্বদেশে পরবাসী’, ‘একাত্তরের ঢাকা’, ‘ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন’ ইত্যাদি তার জনপ্রিয় প্রবন্ধ। কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন ‘কাকতাড়ুয়া’, ‘চাঁদের বুড়ি পান্তা ইলিশ’, ‘আকাশ পরী’, ‘এক রূপোলি নদী’ সহ বেশ কিছু সুপাঠ্য গ্রন্থ। সাহিত্যাঙ্গনে এই অনবদ্য অবদানের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে। এছাড়াও তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’, ‘রবীন্দ্রস্মৃতি পুরস্কার’, ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ সহ অসংখ্য পদক পুরস্কার পেয়েছেন।