"সোনালি কাবিন ও নির্বাচিত ১০০ কবিতা" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ আধুনিক বাংলা কবিতায় দ্রাঘিমাংশে সার্বভৌম স্বাধীন এক জীবন্ত কিংবদন্তির নাম আল মাহমুদ। পৃথিবীর যেখানেই বাংলা ভাষা সেখানেই তাঁর অধিষ্ঠান অনিবার্য। বিগত শতাব্দীর বাংলা কবিতা তাঁরই সৌকর্যে স্পর্ধিত। মূলত তিনিই প্রবলভাবে সব্যসাচী, তাঁর মতাে আর কেউ নন। সােনালি কাবিন আধুনিক বাংলা কবিতার আবহমান বাংলা ও বাঙালির প্রামাণ্য দলিল। চার দশক অতিক্রম করে সােনালি কাবিন তাঁর পাঠকের কাছে আজো জ্যোতির ঝালরে উজ্জ্বল। বােধ করি এ কথা উচ্চারণ করা কোনাে অর্থে অতিরিক্ত হবে না যে যতদিন বাংলা ভাষা ততদিন সােনালি কাবিন। প্রেম-প্রকৃতি-প্রার্থনার কবি হিসেবে তিনি অভিষিক্ত, তাঁর কবিতা পাঠকের হৃদয়ে মননে। যখন চারদিকে এত অবিশ্বাস এত অশ্রু এত রক্ত তখন তার কবিতার দিকে প্রত্যাবর্তন হয়ে ওঠা প্রাসঙ্গিক। আপাত কোনাে বিশ্রামের জন্য নয়, শান্তির পথ রেখা খুঁজে পেতে বারবার তাঁর কবিতার দিকে ফিরে আসা যেন এক অনিবার্য নিয়তি। কালের প্রবাহে বাংলা কবিতার নতুনতর পাঠকের কাছে সােনালি কাবিন-এর প্রয়ােজন প্রতিষ্ঠিক। সেই বিবেচনায় বক্ষমান গ্রন্থে সােনালি কাবিন-এর সাথে সংকলিত হয়েছে প্রেম-প্রকৃতি-প্রার্থনার আরাে শত কবিতা।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলম’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।