পৃথিবীর সমৃদ্ধতম ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা ভাষা একটি। নানা আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গত দেড় হাজার বছর ধরে এই ভাষা অগ্রসর হয়ে চলেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই হাজার বছরের ইতিহাস সত্ত্বেও ১৯৭১-এর আগে এই ভাষার প্রকৃত রাষ্ট্রীয় মর্যাদা ছিল না। ভাষা আন্দোলন সেই মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত করেছিল। সেই আন্দোলনের অর্ধশতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে ২০০২ সালে। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টি করলেই জাতিরাষ্ট্র গঠনের কাজ শেষ হয়ে যায় না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে আত্মপরিচয়, চেতনা ও রাষ্ট্রভাবনার উদ্গম ও বিকাশের ধারণা নবায়িত করার মধ্য দিয়েই জাতিরাষ্ট্র প্রাণশক্তিতে উত্তরোত্তর বলীয়ান হয়ে ওঠে। সেই চেতনা থেকেই মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ। গাঙ্গেয় বদ্বীপের ২৫ কোটি মানুষ আজ বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষায় রচিত গদ্য-পদ্যেরও শেষ নেই। তারই বিভিন্ন মাত্রিক একটি নির্বাচিত চয়নিকা এই মহাগ্রন্থ; ভাষা-আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে। বাংলা ভাষার মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বকে উপজীব্য করে বাঙালি কবি, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিন্তানায়ক ও গবেষকের গত চার শ’ বছরের মনের ভাব ও ঋদ্ধ চিন্তা-ভাবনা এই গ্রন্থে পাওয়া যাবে। এতে আছে বাংলা ভাষাপ্রীতি, বাংলা ভাষার ইতিহাস, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, বিবর্তন, বাংলা ভাষা ও ভাষাবিতর্ক নিয়ে ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরে আমাদের বরেণ্য জ্ঞানীজনদের লেখা; ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রবন্ধ, কবিতা, ছড়া ও গান; ভাষাবিতর্ক নিয়ে বিভাগপূর্ব পত্রপত্রিকার সম্পাদকীয় এবং ভাষাসৈনিকদের স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকার। বাংলা ভাষার নানা ঐতিহাসিক কালপর্বে দু’বাংলা থেকে নির্বাচিত লেখকের সৃষ্টিশীল ও গবেষণামূলক রচনাসম্ভারে সমৃদ্ধ এই গ্রন্থটি একটি অনন্য প্রকাশনা। গ্রন্থের বিষয় পরিধি যেমন সুবিস্তৃত, তেমনি এর লেখক পরিধিও বিশাল। প্রাচীন ও মধ্যযুগের শাহ মুহম্মদ সগীর, ভারতচন্দ্র রায়, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম থেকে আধুনিক যুগের রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ হয়ে এ প্রজন্মের গবেষক প্রতিনিধি পর্যন্ত। তিন শতাধিক লেখকের বাংলা ভাষা ও ভাষা আন্দোলন বিষয়ক লেখার সমাবেশ ঘটানো হয়েছে এই গ্রন্থে। মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ তাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নয়, বরং এখানে ইতিহাসের উপাদানগুলোকে অনেক মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য অখ- আকারে গ্রন্থিত করা হয়েছে। এই গ্রন্থ আজ ও আগামীর বাংলা ভাষাভাষী পাঠকবৃন্দের বাংলা ভাষা, বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ এবং ভাষা আন্দোলন সংক্রান্ত ঐতিহাসিক তথ্য পিপাসার অনেকটুকুই পূরণ করতে পারবে। মহান একুশে সুবর্ণজয়ন্তী গ্রন্থ যেমন একুশের, তেমনি বাংলা ভাষারও স্মারক। এর ২৮টি পর্ব রয়েছে। পর্বগুলো হল : > বাংলা ভাষা আমার অহংকার > আ-মরি বাংলা ভাষা > বিবর্তন > মুদ্রণশিল্প > ভাষা বিতর্ক > ভাষা আন্দোলনের পটভূমি > পথিকৃৎ > বায়ান্নর একুশে > সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলন > ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি > ভাষাসৈনিক > ভাষা আন্দোলনে নারী > ভাষা শহীদ > জেলায় জেলায় ভাষা আন্দোলন > ভাষা আন্দোলন : দেশে দেশে > বিদেশে বাংলাচর্চা > শহীদ মিনার > ভাষা আন্দোলনে রাজনীতি-সংস্কৃতি-অর্থনীতি > ঐশ্বর্য > উৎসৃজন > একুশের সংকলন > আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস > ভাষা সংস্কার > বাংলা চর্চা ও ব্যবহার > সর্বস্তরে বাংলা : সমস্যা > সাক্ষাৎকার > ভাষা আন্দোলনের দলিল > বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ২৮টি পর্বে বিভক্ত এই সুবৃহৎ গ্রন্থটির বিস্তৃত সম্পাদকীয়, সহায়কগ্রন্থ ও তথ্যপঞ্জি, লেখক-নির্ঘণ্ট ও লেখক-পরিচিতি এটিকে বাংলা ভাষার এনসাইক্লোপেডিয়া-সদৃশ আকরগ্রন্থে পরিণত করেছে।
মাহবুর উল্লাহ্ । জন্ম ৯ ডিসেম্বর ১৯৪৫, নােয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জের তিতাহাজরা গ্রামে। বৈচিত্র্যময় বর্ণাঢ্য জীবনের মানুষ। কর্মজীবন সক্রিয় রাজনীতি থেকে অধ্যাপনা ও গবেষণা পর্যন্ত বিস্তৃত। '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের বিপ্লবী নেতা। ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র কর্মসূচি উত্থাপনের অপরাধে। ইয়াহিয়ার সামরিক আদালতে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে দীর্ঘ ২২ মাস কারান্তরালে অন্তরীণ থাকার পর ১৯৭১-এর ১৭ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা তাঁকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন। রাজনৈতিক জীবনে তিনি মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, হাজী মােহাম্মদ দানেশ, মােহাম্মদ তােয়াহা, কমরেড আবদুল হক, কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার, কমরেড দেবেন সিকদারের সাহচর্যে আসেন । ১৯৭২ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন । ছাত্রজীবন থেকেই ইংরেজী ও বাংলা সংবাদপত্রে লেখালেখি করে আসছেন। জাতীয়তাবাদী চিন্তা-ভাবনার আর্থ-সামাজিক, ঐতিহাসিক ও দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ তাঁর সাম্প্রতিক লেখালেখির মূল। উপজীব্য। ১৯৭৬ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। ২০০৬ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে নিয়ােজিত থেকে অবসরে যান। পরবর্তীতে ঐ বিভাগের প্রফেসর ও সােনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি রাজস্ব সংস্কার কমিশনের সদস্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম প্রাে-ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রীর অধিকারী প্রফেসর মাহবুব উল্লাহ্ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বােস্টন বিশ্ববিদ্যালয় ও জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা ও গবেষণা করেছেন। এছাড়া তিনি কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (IDRC), ডেনমার্কের সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ, নেপালের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইনটিগ্রেটেড মাউন্টেইন ডেভেলপমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং ইউনাইটেড ন্যাশনস ইউনিভার্সিটির সহযােগিতায় গবেষণা। কাজ করেছেন। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তার তেরটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া দেশবিদেশে তাঁর গবেষণা প্রবন্ধসমূহ প্রকাশিত হয়েছে।