রুদ্রপ্রহর উপন্যাসের ফ্ল্যাপ চারপাশে হেঁটে বেড়ানো মানুষ; সবকিছু চলছে, ঠিকঠাক- যেনো কিছুই হয়নি কোথাও। কিন্তু ভেতরে ভেতরে লুট হচ্ছে স্বপ্ন; গাঢ় রক্তক্ষরণে প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে হৃদপিণ্ড। সাতচল্লিশ থেকে একটি দীর্ঘ ইতিহাসের সরণি ধরে আমরা হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটছি এখনও। কারও পায়ে দগদগে ঘা, কারও বা মখমলের জুতো। সময়ের বিস্তীর্ণ ক্যানভাসে জীবনের এক করুণ প্যাস্টেল চিত্র দেখছি প্রতিদিন, আবার সেই চিত্রটাই রেখে যাচ্ছি অনাগত সময়ের জন্য। সময়ের আয়নায় আমরা নিজেদের ক্ষয়ে যাওয়া মুখগুলো দেখছি প্রতিদিন। দেখতে দেখতে ক্লান্ত হচ্ছি, কিন্তু হেরে যাচ্ছি কি? এই প্রশ্নটিকে মনে রেখেই এতো দীর্ঘ ব্যাপ্ত একটি উপন্যাস লিখেছেন মারুফ রসূল। শিল্প তাঁর কাছে যুদ্ধের একটি অস্ত্র। যে যুদ্ধ মানুষের জন্য, মানুষের চোখে দেখা রাজনীতির জন্য। তাঁর আগের উপন্যাস- ছায়াপথিকের বাতিঘরের মতোই এখানেও গাঢ় স্বরে উচ্চারিত হয়েছে মানুষের উদ্বোধিত সত্তা। আজকের এই প্রতিদিনের বেঁচে থাকায় আমাদের ইতিহাসের ব্যতিচারটি কোথায়? আমরা কতোটুকু ছিটকে যাচ্ছি নিজস্ব অক্ষাংশ থেকে? সকলেই সরে যাচ্ছেন, না কি কেউ কেউ আছেন, যারা ফিরে যাচ্ছেন মাটির কাছে, শেকড়ের কাছে। ‘রুদ্রপ্রহর’ সেই ফিরে আসা, সেই ছিটকে পড়া মানুষদেরই আখ্যান।
মারুফ রসূল বাঙলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনীতি সচেতন লেখক; তিনি ঔপন্যাসিক, গল্পকার, রাজনীতি বিশ্লেষক এবং সমালোচক। তাঁর রচনা অন্তর্ভেদী, তীব্রভাবে সংবেদনশীল এবং নানাভাবে আলোচিত-সমালোচিত। ইতিহাস, সমকালীন রাজনীতি, সাহিত্য ও চলচ্চিত্র বিষয়ে গবেষণামূলক ব্লগিং এর জন্যে তিনি যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত। জন্ম ১৯ ফাল্গুন ১৩৯৩: ০৩ মার্চ ১৯৮৭ ঢাকায়। পড়াশুনা করেছেন গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে তিনি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। তাই ধর্মনিরপেক্ষ ও মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক নানা আন্দোলনে তিনি সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ২০১৩ সালের ০৫ ফেব্রুয়ারি থেকে চলমান দুনিয়া কাঁপানো শাহাবাগ আন্দোলনের তিনি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। এই আন্দোলনের নানা গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র তৈরিতে তিনিই মূল উদ্যোক্তা হিশেবে কাজ করেছেন। এই আন্দোলনের ইতিহাস তাঁর রচনার মধ্য দিয়েই ক্রমান্বয়ে লিখিত হচ্ছে। চলমান শাহাবাগ আন্দোলনের নানা বিষয় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনার ক্ষেত্রেও তিনি অগ্রসর ভূমিকা পালন করে চলেছেন। মারুফ রসূল বিশ্বাস করেন, শিল্প হলো একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। বস্তুত এ কারণেই তাঁর রচনার প্রাণ হয়ে উঠে মানুষ। রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে রচিত তাঁর সাহিত্যকর্মগুলো তাই শেষ পর্যন্ত মানুষের কণ্ঠস্বর- যে মানুষ নির্মাণ করে ইতিহাস, গতিশীল করে সভ্যতাকে- সে-ই মানুষই মারুফ রসূলের শিল্পসত্তার স্থপতি। দর্শনকে তিনি সাহিত্যে রূপ দিয়ে ছড়িয়ে দিতে চান মানুষের মধ্যে, কারণ তিনি কেবল এবং কেবলমাত্র বিশ্বাস করেন মানুষের পবিত্রতম উদ্বোধন আর যূথবদ্ধ জীবনাচরণে। সাহিত্যে তিনি নিজস্ব একটি ধারা তৈরি করে চলেছেন- তাঁর শব্দচয়ন তাই তাঁরই জীবনবোধের মতো রক্তাক্ত, তীব্র এবং স্বপ্নময়। ব্লগিং এর ক্ষেত্রেও তিনি অপ্রতিম একটি ধারা সৃষ্টি করেছেন, যা আবেগাক্রান্ত হলেও নিষ্ঠুরভাবে নির্মোহ। শিল্পকে রাজনীতির শক্তিশালী হাতিয়ার জেনেই এখনও কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। মিছিলের কণ্ঠস্বরকে তিনি যেমন তুলে আনছেন সাহিত্যে, তেমনি প্রতিবাদের দীপ্র মশাল জ্বেলে এগিয়ে যাচ্ছেন আলোকচিত্র ও চলচ্চিত্রেরও দিকে। শিল্পের নানা শাখা কাজ করার ব্রত নিয়ে তিনি প্রতিদিন যেমন নির্মাণ করছেন নিজেকে, তেমনি ভাঙছেনও দিনরাত। বস্তুত এ কারণেই তাঁর চলার পথ এখনও কঠিন, বিপদশঙ্কুল, বাধা-বিপত্তিময় হলেও সত্য। আদর্শের প্রতি এই নিখাদ সততাটুকুই তাঁর একমাত্র সম্বল। এছাড়া মারুফ রসূলের আর কিছুই নেই।