"অর্ধেক জীবন" বইটির মুখবন্ধ থেকে নেয়াঃ ধারাবাহিকভাবে এই রচনা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশের সময় ও সমাপ্ত হলে অনেকে আমাকে প্রশ্ন ও অভিযােগ করেছেন, আমি ‘অর্ধেক জীবন’ নাম দিয়েছি কেন, আমি কি আমার আয়ুর সীমানা জানি? কিংবা অকস্মাৎ এ রচনা শেষ হয়ে গেল কেন, দ্বিতীয় খণ্ড কি আবার লেখা হবে? অতি সংক্ষেপে এর উত্তর এই যে, নামকরণের সঙ্গে আমার আয়ুর কোনও প্রশ্নই নেই, পুরাে জীবনের কথা কেউ কখনও লিখতে পেরেছেন কি না আমি জানি না, তা ছাড়া, শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের যে-উক্তিটি আমি উদ্ধৃত করেছি, তার মধ্যেই এই নামকরণের তাৎপর্য নিহিত আছে। এর পরের খণ্ড আর লেখার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এ রচনা আমি মধ্যপথে সমাপ্ত করিনি, এইটুকুই এর পূর্বপরিকল্পিত নির্দিষ্ট পরিধি। পূর্ববাংলার এক অখ্যাত গ্রামে জন্ম। বহু বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন, এর মধ্যে একটা বৃত্ত আছে। এবং চল্লিশপঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিপদসঙ্কুল, কঠিন, ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন টিকিয়ে রাখা, যাকে বলে জীবনসংগ্রাম, সব কিছুই অনিশ্চিত, তারই মধ্যে নানা রকম আশা, আকাক্ষা ও ভালােবাসা, অনেক স্বপ্ন, সেই বয়েসটার কথা লিখতে চেয়েছি। এটাকে ঠিক আত্মজীবনীও বলা যায় না। নিজের অন্তৰ্জীবনের কথা বলা যায় না কিছুতেই, অনেক সময় মনে হয় তা অকিঞ্চিৎকর, অন্যকে জানাবার মতন নয়, আমার পারিবারিক কাহিনীও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত, বরং সমসাময়িক স্মৃতিকথাই প্রাধান্য পেয়েছে, কাছাকাছি ইতিহাসের পটভূমিকা এবং উল্লেখযােগ্য ঘটনাবলী। এর পরবর্তী অংশ না লেখার প্রধান কারণটিও এখানে ব্যক্ত করা যায়। এই অংশে আমি এমন অনেক মানুষের কথা লিখেছে, আমার সেইসব প্রিয় মানুষ আর ইহলােকে নেই, বন্ধুদের মধ্যেও কেউ কেউ চিরবিদায় নিয়েছে, তাঁদের মৃত্যুর কথা লিখতে আমার কলম অক্ষম। আমার এই স্মৃতিকাহিনীতে তাঁরা জীবন্ত হয়েই থাক। শুধুমাত্র আমার বাবার মৃত্যুর কথা লিখতেই হয়েছে প্রসঙ্গক্রমে।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।