"মুক্তিযুদ্ধের সুনির্বাচিত গল্প" বইটির প্রবেশক নামক অংশ থেকে নেয়াঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির জাতীয় জীবনে গৌরবময় ও বীরত্বপূর্ণ এক অধ্যায়। একইসঙ্গে গর্বের ও বেদনার। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসন জাতির কাঁধে চেপে বসেছিল জগদ্দল পাথরের মত। সে এক দুঃসহ পরিস্থিতি। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নিরীহ বাঙালিকে সহ্য করতে হয়েছে অবর্ণনীয় শােষণ বঞ্চনা বৈষম্য দুর্ভোগ নিপীড়ন। সেই নিগ্রহ নিবর্তন ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্মম। সঙ্গত কারণেই অনিবার্য হয়ে ওঠে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ, প্রতিরােধ। পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের ব্যাপক ও বহুমাত্রিক জুলুম নির্যাতনের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দারা ছিলেন সর্ব পর্যায়ে শােষিত নিপীড়িত। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে দীর্ঘকাল ধরে সহ্য করতে হয় বহুমাত্রিক অত্যাচার, লাঞ্ছনা ও অপমান। অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়ােজনে রুখে দাঁড়াতে হয় বাঙালিকে। বন্ধু তােমার ছাড়াে উদ্বেগ সুতীক্ষ করাে চিত্ত/বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুবৃর্ত- কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই অগ্নিঝরা কবিতাপঙক্তির মত অমােঘ শক্তিতে ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে বাঙালি অস্ত্র তুলে নেয় হাতে। লক্ষ্য একটাই-স্বাধীনতা। সোঁদামাটির দেশ বাংলাদেশ হয়ে ওঠে গেরিলাযুদ্ধের ক্ষেত্র। বাঙালি জাতির অসামান্য সেই বীরত্ব, সর্বাত্মক সেই ত্যাগ, অদম্য সেই দৃঢ়তার কোনাে তুলনা নেই। বায়ান্নর মহতী ভাষা আন্দোলনে জাতীয় স্বরূপ অন্বেষার দীর্ঘ ও কঠিন যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল- তা উজ্জ্বলতম ও চূড়ান্ত অবয়ব পায় একাত্তরে এসে। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন একটি দেশের। রক্তে পাওয়া সেই দেশের নাম বাংলাদেশ। সেই অহঙ্কার অর্জিত হয় লাখাে শহীদের রক্ত, অগুনতি মা-বােনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে। পাক হানাদার বাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর পাশবিক হত্যাকাণ্ড চালায়। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মাতৃভূমি রক্ষার মৃত্যুপণ লড়াইয়ে। দিনে দিনে ব্যাপকতর হয়ে ওঠে সেই জনযুদ্ধ। শেষপর্যন্ত বাঙালির মরণপণ সংগ্রাম ছিনিয়ে আনে বহুল প্রত্যাশিত রক্তিম সূর্যস্বাধীনতা। কোটি প্রাণ একটি ঐকতানে বেজে উঠেছিল একাত্তরে। মােটেও সহজ ছিল না সেই যুদ্ধ। আমরা জানি, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব, প্রগতি সমৃদ্ধি অর্জনের যে সংগ্রাম, সেই সংগ্রামের পথ সব সময়েই বন্ধুর, কাঁটা বিছানাে। বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, চারুকলা সব ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধ তার আপন অহং উচ্চতা ও দৃঢ়তায় প্রতিফলিত। সে এক অত্যাশ্চর্য বাঁকবদল। কোটি প্রাণের সম্মিলনে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় গর্ব ও প্রগতির পথে এগােনাের অনিঃশেষ পাথেয়। বাংলাদেশের নবীন প্রবীণ গল্পকাররা তাদের মূল্যবান সেইসব অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন আকাক্ষা ও কল্পনা কুশলী বুনটে মহৎ মুক্তিযুদ্ধকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। অনেকেরই মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা শিল্পরসে জারিত হয়ে হৃদয়গ্রাহী ব্যঞ্জনায় মূর্ত উদ্ভাসিত হয়েছে। উজ্জ্বল সেই ইতিহাস, রক্তক্ষরণ, গাঢ়গভীর দেশপ্রেম, বীরত্বগাথার নিটোল নিপুণ ছবি আঁকা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বহু গল্পে। এই গ্রন্থে সেই বিপুল সৃষ্টিসম্ভার থেকে নির্বাচিত কিছু গল্প স্থান পেয়েছে। জীবন ও সম্ভ্রমের মূল্যে অর্জিত হয়েছিল যে স্বাধীনতা, একাত্তরের পর আনন্দ ঔজ্জ্বল্যকে মলিন করে দিয়েছে স্বপ্নভঙ্গের হতাশা ও বেদনাবােধ। স্বাধীনতা উত্তরকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঠিক সংহত লালন ও বিকাশ ঈপ্সিত গতি ও মূল্যায়ন পায়নি। এই অসম্পূর্ণতার যন্ত্রণা, নৈরাশ্য ও অপূরণের গ্লানি, মনােবেদনাও উপজীব্য হয়েছে কোনাে কোনাে গল্পে। নিরস্ত্র মানুষ জীবন বাজি রেখে ব্যাপৃত হয়েছিলেন সেই অসম যুদ্ধে। তীব্র আত্মসম্মানবােধ জিগীষায় প্রাণিত করেছে তাদের। শেষ পর্যন্ত পদানত হয়েছে দানবীয় শক্তি। অশুভ ছায়া অপসৃত হয়েছে, শহীদের শােণিতে সিক্ত ও পবিত্র হয়েছে বাংলার মাটি। স্বদেশের সম্মান বাঁচানাের সেই যে সর্বপ্লাবী সংগ্রাম ছিল উনিশ শ একাত্তরে, তাতে শরীক হয়েছিলেন সর্বস্তরের সকল বয়সের সকল পেশার মানুষ। সমগ্র জাতি একটি কেন্দ্রবিন্দুতে ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছে। স্বপ্নলালিত সেই অভীষ্টের নাম স্বাধীনতা। মুক্তিযুদ্ধ কখনাে শেষ হয় না। এটি চলমান এক প্রক্রিয়া। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের ভিত্তিভূমি। প্রতিবাদ ও দ্রোহ আমাদের জাতিসত্তা বিনির্মাণের মূল উপাদান। এই অভিজ্ঞতা লাভের সুযােগ আগে কখনাে হয়নি আমাদের। সঙ্গত কারণেই সেই স্বপ্ন, অর্জন ও আকাক্ষা আমাদের কথাশিল্পে সার্থকভাবে রূপায়িত, প্রতিফলিত হয়েছে। কথাসাহিত্যিকদের রচনা ওই মৌল উপাদানকে শিল্পরসদে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে উপস্থাপন করেছেন পাঠকসমীপে। তার মধ্যে রয়েছে বৈচিত্র্য, শিল্পোৎকর্ষের পরিচয়, আঙ্গিকে বিষয়ে নতুন মাত্রার উদ্ভাসন, এমনকি সাহসী পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ছাপ। সমৃদ্ধি, স্থিতি, প্রগতি ও কল্যাণের পথে হাঁটতে হলে মুক্তিযুদ্ধের কাছে ফিরতে হবে বারংবার। এর কোনাে বিকল্প নেই। আশ্চর্য সেই সময়ের আর্থসামাজিক রাজনৈতিক চালচিত্রের হৃদয়স্পর্শী পরিচয় আমরা এই গ্রন্থের গল্পগুলােতে যেমন পাবাে, তেমনি শিল্প রসগুণের উৎকর্ষও আলােড়িত, আনন্দিত এবং আপুত করবে আমাদের।
হাসান হাফিজের জন্ম নারায়ণগঞ্জের সােনারগাঁও উপজেলার এলাহি নগর গ্রামে, ১৫ অক্টোবর ১৯৫৫। যখন ছিলেন স্কুলছাত্র, প্রথম ছড়া ছাপা হয় ইত্তেফাকের কচি কাঁচার আসরে। পড়াশােনা করেছেন হােসেনপুর হাই স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য,গণযােগাযােগ ও সাংবাদিকতায় এম.এ.(ডাবল)। দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত। দৈনিক বাংলায় সূচনা। আরাে কাজ করেছেন জনকণ্ঠ, কলকাতার সাপ্তাহিক দেশ (এখন পাক্ষিক), বৈশাখী টেলিভিশন এবং আমার দেশ-এ। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ ১৪০। সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় অবদান রাখার স্বীকৃতি হিসেবে এই লেখক পেয়েছেন বহু সম্মাননা ও পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, ডাকসু সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাঙ্ক শিশুসাহিত্য পুরস্কার, কলকাতার সৌহাদ্য কবিতা উৎসব সম্মাননা, জাতীয় প্রেস ক্লাব লেখক সম্মাননা, ঢাকা রিপাের্টার্স ইউনিটি লেখক সম্মাননা, কবিতালাপ পুরস্কার, কবি জসীম উদ্দীন স্মৃতি পুরস্কার, এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার, স্বপ্নকুঁড়ি পদক ইত্যাদি। হাসান হাফিজ বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (এফইজেবি) সাধারণ সম্পাদক, বাংলা একাডেমির জীবন সদস্য। সাহিত্য-সাংবাদিকতা সূত্রে ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের ১৫ দেশ। তার স্ত্রী শাহীন আখতার ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের প্রাক্তন সহকারী অধ্যাপক। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ডা. শিহান তাওসিফ গৌরব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত।