"শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক উপন্যাস" বইটির প্রথম ফ্ল্যাপ-এর লেখাঃ রবীন্দ্রনাথের গানে আছে ‘ভালােবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন মিছে ভালােবাসা'। আবার লােকগানে আমরা শুনতে পাই সরল প্রাণের বিষাদিত স্বীকারােক্তির মূৰ্ছনা-‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না...'। মানুষের সঙ্গে মানুষের যে নানা ধরনের সম্পর্ক বিদ্যমান, তার মধ্যে প্রেমের বন্ধনই বােধকরি সবচেয়ে বেশি আরাধ্য, একইসঙ্গে সর্বাধিক সংবেদনশীলও। প্রাপ্তির আনন্দ ও হারানাের আর্তি-বেদনা এই সম্পর্কের মধ্যে যতটা গভীর ও নিবিড়ভাবে ওতপ্রােত, অন্য সম্পর্কে সেটা নেই। মর্মকাপানাে, হৃদয়ছোঁয়া প্রেমের উপন্যাস লেখায় হুমায়ূন আহমেদের কোনাে জুড়ি নেই। জননন্দিত এই কথাশিল্পীর তুলনা ও প্রতিদ্বন্দ্বী তিনি নিজেই। তাঁর লেখার প্রসাদগুণ ও বৈশিষ্ট্য এমনই যে তা পাঠককে দ্রুত পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। সে এক রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর্ব। উপন্যাস একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত স্বস্তি নেই পাঠকের। আপাতসরল মিতকথনের আড়ালে লুকোনাে থাকে তির্যক ব্যঙ্গ-রঙ্গ, হাস্যরস, গভীর জীবনদর্শন, সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব, দ্বিধা, সংশয়, মানবিক সম্পর্কের মিহি টানাপড়েন। উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীর আহত আবেগ পরাস্ত রক্তাক্ত হয় কঠিন বাস্তবের চাবুকে। কথাশিল্পের জাদুকর হিসেবে খ্যাতিমান হুমায়ূন আহমেদ জমিয়ে গল্প বলতে জানেন। এই মুন্সিয়ানা ও সাফল্যের স্বীকৃতি হচ্ছে এখনাে পর্যন্ত তাঁর। রচনাসমূহের ব্যাপক জনপ্রিয়তা, পাঠকের আগ্রহ-কৌতূহল তাঁর মৃত্যুর পরও তা ম্লান হয়নি। আপাতদৃষ্টে কখনাে কোনাে সাধারণ ঘটনা ভিন্ন ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয় পাঠকসমীপে। আবার কোনাে কোনাে চরিত্রের উদ্ভট, অদ্ভুতুড়ে কাণ্ডকারখানাও আমরা সবিস্ময়ে লক্ষ করি। কুশলী বুননে সহজাত নৈপুণ্যে তিনি নির্মাণ করেন মানুষের মনের গহন প্রদেশের নিভৃত অনুভব, শিহরণ, আনন্দ-বেদনার চমৎকার চিত্রমালা। শ্রেষ্ঠ রােমান্টিক উপন্যাস সিরিজে এবার অনুপম প্রকাশনী মলাটবন্দি করেছে হুমায়ূন আহমেদের মনকাড়া পাঁচটি জমজমাট প্রেমের উপন্যাস-কৃষ্ণপক্ষ, নবনী, শ্রাবণ মেঘের দিন, দীঘির জলে কার ছায়া গাে এবং রূপা। হাসান হাফিজ
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।