ভূমিকা বিশ্বের সবচাইতে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের লেখক ডেল কার্নেগির ক্যারিয়ার উন্নয়ন ও সাফল্য বিষয়ক তিনটি গ্রন্থের সংকলন “ক্যারিয়ার উন্নয়নসমগ্র।” আমাদের ক্যারিয়ার উন্নয়নে যোগ্যতা ও দক্ষতার জন্য চাই আত্মবিশ্বাস ও সাহস। ডেল কার্নেগি খুব সহজভাবে কার্যকরী পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আত্মবিশ্বাস ও সাহস এবং জনসমক্ষে কথা বলার সময় শান্ত ও স্বচ্ছভাবে চিন্তা করার যোগ্যতা অর্জন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের যে ধারণা, এ ঘটনা প্রমাণ করে যে আসলে সে ধারণা স্বাভাবিক অবস্থা নয়। এটা শুধু মাত্র কতিপয় ব্যক্তির প্রতি স্বর্গীয় অবদান বা ঈশ্বরের দান নয়। এটা গলফ খেলার মতো যোগ্যতা অর্জনের ব্যাপার। যে কোনো ব্যক্তিই ইচ্ছা করলে চর্চার মাধ্যমে এই যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম। আমরা যোগ্যতা অর্জনের জন্য যে চর্চা, অনুশীলন বা চেষ্টা করি তা আমাদের ক্যারিয়ারের উন্নতির সেরা উপায় হিসেবে কাজ করে। আমাদের আত্মবিশ্বাস ও সাহসিকতা দক্ষতা ও যোগ্যতাকে বিকশিত করে। তখন আমরা সফলতার পথে এগোতে থাকি। আমেরিকার খ্যাতনামা মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক উইলিয়ম জেমস লিখেছেন : যে কোনো কাজের পর জাগে অনুভূতি। কিন্তু বাস্তবে কাজ ও অনুভূতি এক সাথেই চলে। ইচ্ছাশক্তি কাজকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তদ্বারা আমরা অনুভূতিও নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সুতরাং মনে আনন্দ সৃষ্টির সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে এমন কাজ এবং এমনভাবে করা যাতে মনে আনন্দের আবেগ সৃষ্টি হয়, আনন্দ হয়। একবার চেষ্টায় মনে এ আনন্দ আনা না গেলে বারবার চেষ্টা করতে হবে। অনুরূপ ভাবে, নিজেকে সাহসী বলে ভাবতে হলে যে কোনো কাজ সাহসিকতার সাথে করতে হবে। এই কাজে সর্বশক্তি নিয়োগ করুন, দেখবেন আস্তে-আস্তে ভয় দূরীভূত হয়ে গেছে, সাহস এসেছে মনে। সাধারণ্যে বক্তৃতা করতে দাঁড়িয়ে আপনি অধ্যাপক জেমসের উপদেশ অনুসরণে কাজ করুন, ভাবুন এটি শ্রোতাদের সামনে আপনার প্রথম দিন নয়। অবশ্যই আপনি যদি প্রস্তুত না থাকেন তবে আপনি পুরোপুরি সফল হবেন না। আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে, শ্রোতাদের সামনে আপনি কী বলতে যাচ্ছেন। বক্তৃতা শুরু করার আগে আপনি দীর্ঘশ্বাস গ্রহণ করুন। ফুসফুসে অধিক অম্লজান আপনাকে অধিক শক্তি ও সাহস জোগাবে। জীন ডি রেস্কী সব সময় বলতেন, আপনি দীর্ঘশ্বাস নিন, তা হলে আপনার শক্তি ও সাহস বাড়বে। সর্বযুগে, সকল দেশে, মানুষ সব সময় সাহসের প্রশংসা করেছে। সুতরাং মঞ্চে দাঁড়িয়ে আপনাকে এমনভাবে বক্তব্য পেশ করতে হবে যাতে শ্রোতারা মনে করে আপনি যা করছেন তা দৃঢ় বিশ্বাস ও সাহসিকতার সাথে করছেন। প্রমাণ করতে হবে আপনি সাহসী। সাহস ব্যক্তির উন্নতি ও কাজের ক্ষেত্রে সবচাইতে বড় টনিক। সাহস না থাকলে আমরা কাজ এবং যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারি না। এটা না পারার কারণেই লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবনে ব্যর্থ হন। সাহস আপনার মনে আত্মবিশ্বাস ও অদম্য শক্তি জোগাবে। খ্যাতনামা বক্তা উইলিয়াম জেনিং বাস্তবায়ান স্বীকার করছেন যে প্রথম দিন বক্তৃতা করার চেষ্টা করলে কম্পনের ফলে তাঁর হাঁটু দুটি জোড়া লেগে গিয়েছিল। মার্ক টোয়েন প্রথম দিন বক্তৃতা করতে উঠে অনুভব করেন যে, তাঁর মুখ গহ্বর তুলা দিয়ে পরিপূর্ণ এবং তার নাড়ির স্পন্দন অস্বাভাবিক রূপে বেড়ে চলেছে। বিসমার্ক ছিলেন তাঁর সময়ের একজন দক্ষ শ্রেষ্ঠতম সেনাপতি কিন্তু তিনি স্বীকার করেছেন যে, তিনি যখন জনসমক্ষে বক্তৃতা করতে চেষ্টা করতেন তখন তিনি অত্যন্ত বেকাদায় পড়তেন। জীন জুরিস ছিলেন তাঁর সময়ের ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠতম রাজনৈতিক বক্তা। কিন্তু ডেপুটিদের চেম্বারে তিনি একটি বছর বোবার মতো বসে কাটিয়েছেন। অতঃপর তিনি চেষ্টা করেন মুখ খুলতে। এঁরা সবাই সাহস আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে প্রথম বার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেন নি। কিন্তু যখনই সাহস করে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন তখনই আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেকে বিকশিত করার শক্তি লাভ করেছেন। মানুষের সঙ্গে কথাবর্তা বলার সময় কখনই যে সব ব্যাপারে আপনার মতের মিল হবে তা দিয়ে শুরু করবেন না, প্রথমেই যে বিষয়ে আপনার মতের মিল হয় তা দিয়েই আরম্ভ করে বারবার সেটাই বলতে থাকুনÑ বারবার জানান মোটামুটি সব ব্যাপারেই আপনাদের মতো একই, শুধু উপায় সম্বন্ধে দ্বিমত থাকতে পারে। অন্য লোকটিকে গোড়াতেই ‘হ্যাঁ’ বলতে দিন। যতদূর সম্ভব তাকে ‘না’ বলতে দেবেন না। এ ব্যাপারে অধ্যাপক ওভারস্ট্রীট তাঁর বই ‘ইনফ্লুয়েন্সিং হিউম্যান বিহেভিয়ার’-এ বলেছেন যে, ‘না’ কথাটা একবার বললে তাকে কাটানো কঠিন কাজ। কোনো লোক না বললে তার সব আত্ম অহমিকাই তাকে তার মতো বদলাতে দেয় না। একবার কিছু বললে সে সেটাই আঁকড়ে থাকতে চায়। তাই এটা অত্যন্ত জরুরি যে আমরা কাউকে সময় দিতে পারলেই ভালো। যারা দক্ষ বক্তা তারা গোড়াতেই বার কয়েক ‘হ্যাঁ’, বলাতে পারেন। তিনি এতে তাঁর শ্রোতাদের মানসিক দিক থেকে স্বমতে আনার পথেই নিয়ে আসেন। এটা অনেকোঁ বিলিয়ার্ড বলের মতো। বলটাকে জোরে ধাক্কা মারুন। সেটা একদিকে ধাক্কা খেয়ে সহজেই বিপরীত দিকে চলে যায়। এতে মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপারটা সহজেই বোঝা যায়। কোনো লোক যখন ‘না’ বলে, যে ওই ছোট্ট কথাটার চেয়ে অনেক বেশি কিছুই করে। তার সমস্ত শারীরিক যন্ত্রই, স্নায়ু, পেশী সব কিছুই বাতিল করতে তৈরি থাকে। সাধারণত : ক্ষুদ্র হলেও শারীরিক যেসব পরিবর্তন হয় তার কিছু প্রকাশ প্রত্যক্ষও করা যায়। শরীরের সমস্ত রকম অনুভূতিই বাধা দিতে যেন তৈরি হয়ে যায়, অন্যদিকে কেউ ‘হ্যাঁ’ বললে ওই বাধা দেবার ব্যাপারটার অস্তিত্বই থাকে না। সমস্ত শরীরের কোষগুলো গ্রহণ করার জন্য এগুতে চায়। তাই গোড়াতেই ‘হ্যাঁ’ বললে আমরা সহজেই অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেও সফল হতে পারি। আমাদের সফলতা অনেকগুলো গুণ ও দক্ষতার ফসল। আপনি যা হতে চান এবং করতে চান তাই আপনাকে মেলে ধরতে প্রেরণা দান করবে। ডেল কার্নেগি আপনার ভেতরর শক্তি, সাহস ও আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তুলে সাফল্যের পথে এগিয়ে চলার অসীম প্রেরণাদাতা। সংকলটিই হতে পারে আপনার সাফল্যের সেরা নিয়ামক।
ডেল ব্রাকেনরিডজ কার্নেগী, এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে ২৪ নভেম্বর, ১৮৮৮ সালে জন্ম নেওয়া এই আমেরিকান লেখক তাঁর আত্ম-উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ পদ্ধতি ও বইয়ের পাতায় আজও বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এক নাম। সেলফ-ইম্প্রুভমেন্ট, সেলসম্যানশিপ, করপোরেট ট্রেনিং, পাবলিক স্পিকিং, ও ইন্টার পার্সোনাল স্কিল এর মতো দারুণ সব প্রশিক্ষণের উদ্ভাবন ও এসব বিষয়ে লেখা ডেল কার্নেগী এর বই সমূহ আশার আলো দেখিয়েছে অসংখ্য হতাশাচ্ছন্ন মানুষকে। মিসৌরিতে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম নেওয়ার দরূণ বালক বয়স থেকেই কাজ করেছেন ক্ষেতখামারে। এর মাঝেও ওয়ারেন্সবার্গের সেন্ট্রাল মিশৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। কলেজ শেষে জীবিকার তাগিদে বেকন, সাবান এবং লার্ড (শূকরের চর্বি মিশ্রিত করা) তৈরির কাজও করতে হয় আর্মর অ্যান্ড কোম্পানির জন্য। ফার্মের প্রধান হিসেবে অনেক সাফল্য লাভ ও ৫০০ ইউএস ডলার সঞ্চয়ের পর ১৯১১ সালে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন অধ্যাপক হওয়ার জন্য বিক্রয় সেবার কাজটি ত্যাগ করেন তিনি। কিছু ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা ঝুলিতে নিয়ে যখন ওয়াইএমসিএ- এর ১২৫ নম্বরে বাস করতে শুরু করেন, তখনই পাবলিক স্পিকিং এর ধারণাটি মাথায় খেলা করে কার্নেগীর। সেই সময় মোট লভ্যাংশের ৮০% শতাংশের বিনিময়ে ওয়াইএমসিএ এর পরিচালকের কাছে শিক্ষা প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করেন। এভাবেই ১৯১২ সাল থেকে কার্নেগী কোর্সের যাত্রা শুরু হয়। পুরো আমেরিকাবাসীর কাছে ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির পথ হয়ে উঠে তার পদ্ধতি। ডেল কার্নেগী এর বই সমগ্র এর মধ্যে ‘হাউ টু উইন ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ইনফ্লুয়েন্স’ বইটিকে তার সেরা অবদান হিসেবে ধরা হয়। প্রথম প্রকাশের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই যার ১৭তম মুদ্রণও প্রকাশ করতে হয়েছিলো। ডেল কার্নেগী এর লেখাগুলো বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। ‘বিক্রয় ও জনসংযোগ প্রতিনিধি হবেন কীভাবে’, ‘বন্ধুত্ব ও সম্পদ লাভের কৌশল’, ‘বড় যদি হতে চাও’, ‘ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সাফল্যের সহজ পথ’ এমন নানা নামের অনূদিত ডেল কার্নেগী বাংলা বই অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে বাংলাভাষী পাঠকদেরও। ডেল কার্নেগী শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র এর মধ্যে আরও আছে ‘দ্য বায়োগ্রাফি অব আব্রাহাম লিংকন’, ‘ফাইভ মিনিট বায়োগ্রাফিস’ এবং ‘বিশ্বায়নের পটভূমি’। ১ নভেম্বর, ১৯৫৫ সালে আমেরিকান এই অধ্যাপক মৃত্যুবরণ করেন।