আজ কি অমাবস্যা? বাইরে গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকারে গা ছমছম করছে। চতুর্পাশ থেকে ঝিঁঝি পোকার বিকট শব্দ তীক্ষ্ণ তীরের মতো অরিনের কানে এসে বিঁধছে। একটু দূরে কোথাও শুকনো পাতা মাড়িয়ে ইঁদুরের হেঁটে যাওয়া শব্দটাও সে উৎকর্ণ হয়ে শুনছে। পাশে কোথাও একটা ব্যাং লাফ দিয়ে পড়ল, সেই শব্দেও তার শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। একটু পরেই আবিষ্কার করল অস্বাভাবিকভাবে সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপছে। গলাটা মরা নদীর মতো ক্রমশই শুকিয়ে আসছে। অরিন অনবরত ঢোক গিলছে। ভীতসন্ত্রস্ত বঞ্চিত অসহায় নারীর মতো উঠোনের গাঢ় অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। সে দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে, বরং তাকে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কঠিন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। দেওয়াল ঘড়ির ছোটো কাঁটা দুয়ের কোঠা প্রায় ছাড়ব ছাড়ব করছে। দু’আড়াই ঘণ্টা যাবৎ অরিন জড়মূর্তির মতো একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে একচুল পরিমাণ নড়ার দুঃসাহস দেখানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। ক্লান্তিতে এখন একটু বিশ্রাম নিলে বাকি রাতের সুখটুকুও ভাগ্যে জুটবে না। তাই শত কষ্ট-ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়লেও নির্দেশ অমান্য করতে চাচ্ছে না। এদিকে তার শরীরিক অসুস্থতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। যে অমানবিক নির্মমতা সহ্য করার অসীম ধৈর্য মেয়েটি সঞ্চয় করেছিল, তা যেন মোমের মতো ধীরে ধীরে গলতে আরম্ভ করেছে। কিন্তু সমস্যা হলো, মোম একটা নির্ধারিত সময়ের উপর নির্ভরশীল, গলতে গলতে একটা সময় নিঃশেষ হয়ে যায়, পড়ে থাকে ভারসাম্য রক্ষার বৃত্তাকারের অবশিষ্ট অংশটুকু, এটা পূর্বনির্ধারিত। কিন্তু জীবনের এই মোম ক্রমাগত গলতে থাকলেও কেউ জানে না এর শেষ অধ্যায় কোথায়! এক অনির্ধারিত কঠিন সময়ের উপর নির্ভরশীল যাপিত জীবন। অরিনের মাথার উপর দিয়ে ডানা ঝাপটে অদ্ভুত, উদ্ভট শব্দ করতে করতে উড়ে গেল নাম না জানা এক নিশাচর পাখি। এই গ্রামে জিন-পরির উপদ্রব আছে শোনা যায়। বদ জিনেরা গভীর রাতে একাকী মানুষের সন্ধান পেলে তারা ভয় দেখাতে সদা প্রস্তুত থাকে। অরিনের শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তিও জোগান দিতে ব্যর্থ হচ্ছে শরীরের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলো। ----