"সেরা সাত হিমু" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: হিমুকে নিয়ে প্রথম লিখি ময়ূরাক্ষী। আসলে হিমু কে? খুব সচেতন পাঠক চট করে হিমুকে চিনে ফেলবেন, কারণ হিমু হল মিসির আলির উল্টো পিঠ । বিজ্ঞানের ভাষায় অ্যান্টি-মিসির আলি। হিমুর কাজকর্ম রহস্যময় জগৎ নিয়ে। সে চলে অ্যান্টি-লজিকে। সে বেশিরভাগ সময়ই বাইরে বাইরে ঘােরে। রাত জেগে পথে পথে হাঁটে কিন্তু সেই সবচেয়ে বেশি অন্তর্মুখী। মিসির আলি চোখ বন্ধ করে পৃথিবী দেখেন। সে চোখ খােলা রাখে কিন্তু কিছুই দেখে না। মিসির আলি দেখতে কেমন আমি জানি না, হিমু দেখতে কেমন তাও জানি না। কোনাে বইয়ে হিমুর চেহারার বর্ণনা নেই। যা আছে তাও খুব সামান্য। সে বর্ণনা থেকে চরিত্রের ছবি আঁকা যায় না। আমার নিজের মনে যে ছবিটি ভাসে তা হল—হাসি-খুশি ধরনের একজন যুবকের ছবি। যে যুবকের মুখে আছে কিশােরের সারল্য। শুধু চোখ দু’টি মিসির আলির চোখের মতােই তীক্ষ। তবে এই দু’টি তীক্ষ্ণ চোখে কৌতুক ঝিকমিক করে। যেন সে সবকিছুতেই মজা পায়। হিমুকে আনতে হয়েছে একটি বিশেষ কারণে । মিসির আলির জগৎ যে একমাত্র জগৎ নয় তা দেখানাের জন্যেই হিমুর প্রয়ােজন হল । লজিক খুব ভালাে কথা, সেই সঙ্গে অ্যান্টি-লজিকও যে লজিক এই তথ্যটিও মনে রাখা দরকার। ইলেকট্রন, প্রােটন, নিউট্রনে এসে পৃথিবী থেমে যায়নি। বস্তুজগতের মূল অনুসন্ধান করতে করতে এখন বিজ্ঞানীরা পাচ্ছেন—আপ কোয়ার্ক, ডাউন কোয়ার্ক, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ... হচ্ছে কী এসব! কোথায় যাচ্ছি আমরা? আমরা কি খুব ধীরে ধীরে লজিকের জগতের বাইরে পা বাড়াচ্ছি ? এই জগতের কথা তাে মিসির আলিকে দিয়ে বলানাে যাবে না। আমাদের দরকার একজন হিমু।
বাংলা সাহিত্যের এক কিংবদন্তী হুমায়ূন আহমেদ। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি লেখকদের মধ্যে তিনি অন্যতম স্থান দখল করে আছেন। একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও নাট্যকার এ মানুষটিকে বলা হয় বাংলা সায়েন্স ফিকশনের পথিকৃৎ। নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবেও তিনি বেশ সমাদৃত। বাদ যায়নি গীতিকার কিংবা চিত্রশিল্পীর পরিচয়ও। সৃজনশীলতার প্রতিটি শাখায় তাঁর সমান বিচরণ ছিল। অর্জন করেছেন সর্বোচ্চ সফলতা এবং তুমুল জনপ্রিয়তা। স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি জাতিকে হুমায়ুন আহমেদ উপহার দিয়েছেন তাঁর অসামান্য বই, নাটক এবং চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রের বদৌলতে মানুষকে করেছেন হলমুখী, তৈরি করে গেছেন বিশাল পাঠকশ্রেণীও। তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমনি’ দেখতে দর্শকের ঢল নামে। এছাড়া শ্যামল ছায়া, শ্রাবণ মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, ঘেটুপুত্র কমলা প্রভৃতি চলচ্চিত্র সুধীজনের প্রশংসা পেয়েছে। অনন্য কীর্তি হিসেবে আছে তাঁর নাটকগুলো। এইসব দিনরাত্র, বহুব্রীহি, আজ রবিবার, কোথাও কেউ নেই, অয়োময়ো আজও নিন্দিত দর্শকমনে। হিমু, মিসির আলি, শুভ্রর মতো চরিত্রের জনক তিনি। রচনা করেছেন নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার, জোছনা ও জননীর গল্পের মতো সব মাস্টারপিস। শিশুতোষ গ্রন্থ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী মিলিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমূহ এর পাঠক সারাবিশ্বে ছড়িয়ে আছে। হুমায়ূন আহমেদ এর বই সমগ্র পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিতও হয়েছে। সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্জন করেছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮১), একুশে পদক (১৯৯৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), মাইকেল মধুসূধন দত্ত পুরস্কার (১৯৮৭), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮), শিশু একাডেমি পুরস্কার, জয়নুল আবেদীন স্বর্ণপদকসহ নানা সম্মাননা। হুমায়ূন আহমেদ এর বই, চলচ্চিত্র এবং অন্যান্য রচনা দেশের বাইরেও মূল্যায়িত হয়েছে৷ ১৯৪৮ সালের ১৩ই নভেম্বর, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলায় কুতুবপুরে পীরবংশে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। গাজীপুরে তাঁর প্রিয় নুহাশ-পল্লীতে তাঁকে সমাহিত করা হয়।