মিনহাজুল আবেদীন হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযযালী (রহ.) ইসলামের এক উজ্জল নক্ষত্র। তিনি তাফসীর, হাদীস, উসূলে হাদীস, উসূলে ফিকহ, কালাম ও যুক্তি বিদ্যা, উসূলে কালাম, আখলাক ও আদর্শ, তাসাওউফ, দর্শন, মুনাজারা ইত্যাদি বিষয়ের উপর একশরও অধিক কিতাব রচনা করেছেন এবং সেসব কিতাব তাঁর জীবদ্দশায়ই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল । তাঁর লেখনী আর চিন্তাধারা কেবল মুসলিম বিশ্বকে আন্দোলিত করেনি, বরং ইউরোপ আমেরিকায়ও তা প্রশংসিত হয়েছে এবং দীর্ঘদিন যাবৎ তারা এ নিয়ে গবেষণা করেছে। ইমাম গাযযালী (রহ.)-এর যুগে বিভিন্ন বাতিল ফেরকা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং তারা নিজেদের বাতিল আকীদা আর মতবাদ অত্যন্ত জোরে শোরে প্রচার শুরু করেছিল । ইমাম গাযালী (রহ.) তাদের রিরুদ্ধে কলম ধারণ করেন এবং অত্যন্ত সফলভাবে তাদের মুকাবিলা করে ইসলামের ব্যাখ্যাকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। যুক্তিবিদ্যার ব্যাপারে তাঁর বর্ণনা আর বাচনভঙ্গি ছিল অতুলনীয় । আজ পর্যন্ত অন্য কেউ তাঁর কাছাকাছি পৌছতে পারেনি। তাঁর মত ইসলামের গবেষক এ পর্যন্ত আর জন্ম গ্রহণ করে নি। ইমাম গাযালী (রহ.)- এর জগদ্বিখ্যাত রচনাবলীর মধ্যে অন্যতম একটি রচনা হল "মিনহাজুল আবেদীন ইলা জান্নাতি রব্বিল আলামীন"। এ বইটি সম্পর্কে ইমাম গাযালী (রহ.)- এর ছাত্র আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন যে, এটি ইমাম সাহেবের সর্বশেষ রচনা। তাঁরা বিশিষ্ট শাগরেদরা ছাড়া অন্য কেউ এটা সংরক্ষণ করেনি। কিতাবের বিষয়বস্তু তার নাম দ্বারাই বুঝে আসে। তাছাড়া লেখক নিজেই এ কিতাব রচনার উদ্দেশ্য ভূমিকার মধ্যে সবিস্তার উল্লেখ করেছেন। যার সংক্ষেপ হল, ইমাম গাযালী (রহ) মানুষ ও জিন সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং তাদের জান্নাতে প্রবেশ করার একমাত্র পথ “ইবাদাত সম্পর্কে তাসাওউফের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এ কিতাবে আলোচনা করেছেন। এ পথের পথিককে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। শয়তান তাকে বিভিন্নভাবে ধোকা দিতে চেষ্টা করে এবং কুপ্রবৃত্তি তাকে ধ্বংসের দিকে কিভাবে ঠেলে দেয় আর তা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ারই বা কি উপায়, সে সম্পর্কে তিনি এ কিতাবে আলোকপাত করেছেন। এছাড়াও অসংখ্য মাসায়িল যার শরীয়ত, তরীকত, মারিফাত ও হাকীকাতের সাথে সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিশেষ পদ্ধতিতে বর্ণনা করেছেন।
বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ., সংক্ষেপে ইমাম গাজ্জালী ছিলেন একজন সুফিসাধক ও মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শিক্ষাবিদ, যিনি তাঁর দর্শন ও চিন্তাধারা বিশ্ব মুসলিমদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর পারিবারিক ব্যবসা সুতা সংক্রান্ত হওয়ায়, সেখান থেকে তার নাম গাজ্জালী হয়েছে বলে ধারণা করা হয়, যেহেতু 'গাজ্জাল' শব্দের অর্থ সুতা। ১০৫৮ খ্রিস্টাব্দে (হিজরি ৪৫০ সাল) ইমাম গাজ্জালী ইরানের খোরাসান প্রদেশের অন্তর্গত তুস নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং এই তুস নগরীতেই তার শৈশবকাল ও শিক্ষাজীবন অতিবাহিত হয়। তিনি ইসলামের স্বর্ণযুগে জন্ম নেন, যে যুগে শিক্ষা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে মুসলমানরা অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো। একইসাথে বিস্তার লাভ করেছিলো পাশ্চাত্য ও গ্রিক দর্শনেরও। ইমাম গাজ্জালী এসকল বিষয়েই দীক্ষা লাভ করেন এবং বিশেষ করে ঐ যুগের বিখ্যাত ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনির কাছ থেকে ধর্মের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। মুসলিম দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ফিকহশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত পারদর্শী । জ্ঞান-বিজ্ঞানের তীর্থস্থান বাগদাদের সেরা বিদ্যাপীঠ নিযামিয়া মাদ্রাসায় তিনি অধ্যাপনা করেন। তিনি তৎকালীন বাদশাহর দরবারেও আসন লাভ করেন। তবে সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের বিষয়ে তীব্র আকর্ষণ থাকায় তিনি জ্ঞান আহরণের জন্য দেশ-বিদেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন ও নানা বিষয় সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন। ইমাম গাজ্জালী রহ. বই রচনার মাধ্যমে তাঁর অর্জিত এসকল জ্ঞান মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ. এর বই সমূহ-তে তিনি আলোচনা করেছেন সুফিবাদ, ইসলামি দর্শন ও ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে, এবং তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা চার শতাধিক। হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী রহ. এর বই সমগ্র এর মধ্যে 'আসমাউল হুসনা', 'মিশকাতুল আনোয়ার', 'ফাতাওয়া', 'মিআর আল ইলম', 'হাকিকাতুর রুহু', 'দাকায়েকুল আখবার' ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১১১১ খ্রিস্টাব্দে (৫০৫ হিজরি) তিনি নিজ জন্মভূমি তুস নগরীতে মৃত্যবরণ করেন। ইসলামের ইতিহাসে তিনি চিরস্মরণীয় একজন মনীষী।