আধুনিক সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে শৈলীবিজ্ঞান (Stylistics) এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ভাষা ও সাহিত্যের সেতুবন্ধ শৈলীবিজ্ঞান । পাশ্চাত্য সাহিত্য-সমালোচকেরা বিশ শতকের সূচনাপর্ব থেকেই শৈলীর চর্চাকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। বাঙলা ভাষা-সাহিত্যের অনুশীলনেও এই চর্চার প্রয়োজনীয়তা ক্রমশ উপলব্ধ হচ্ছে। বর্তমান গ্রন্থের পরিকল্পনা তাই শৈলীবিজ্ঞানকে কেন্দ্র করেই। মধ্যযুগের কাব্যবলয়ে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক মুকুন্দ-কবির ‘কবিকঙ্কণচণ্ডী’ এই গ্রন্থ প্রধানত শৈলীবিজ্ঞানের আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে মধ্যযুগের সাহিত্যকে ফিরে দেখা। মধ্যযুগের আখ্যানকাব্য মঙ্গলসাহিত্য নিয়ে আজ পর্যন্ত কাব্যিক, দার্শনিক বা সমাজতাত্ত্বিক বহু ভাষ্য রচিত হলেও ভাষাগত দৃষ্টিকোণ থেকে কাব্যের রচনাশৈলী নিরূপণের সে-রকম কোনো উল্লেখযোগ্য প্রয়াস লক্ষ করা যায়নি। বস্তুত, কোনো একটি বিশেষ মঙ্গলকাব্যের শৈলীবিজ্ঞান-সম্মত স্বয়ংসম্পূর্ণ আলোচনা এই প্রথম। রচনার ভাষা- অবয়বের নিছক নীরস ব্যাকরণিক ব্যবচ্ছেদ নয়, বরং ধ্বনি-শব্দ-বাক্য এবং সন্দর্ভ (discourse) দিয়ে গড়া বুনোটের পরতে পরতে কবির রচনাশৈলীর অনুসন্ধান এ-গ্রন্থ। শুধু কাব্যের অবয়ব বিচারেই লেখক নিজের ভাবনা সীমাবদ্ধ রাখেন নি, সমাজ-সংস্কৃতির বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপটে কাব্যশৈলীর অনন্য প্রকৌশলগুলি শনাক্ত করেছেন। বিশ্লেষণের বিস্তারিত পরিধিতে সামাজিক অনুষঙ্গ, পৌরাণিক-লৌকিক আদর্শের মেলবন্ধন, লেখকের সমাজ ও শ্রেণীচেতনা, কাব্যের লোকায়ত স্বরূপ প্রভৃতি সমস্ত কিছুই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। গ্রন্থে মঙ্গলকাব্য ঘরানার বিভিন্ন কবির রচনাশৈলীর তুলনামূলক বিচারের মাধ্যমে যুগশৈলীর (period style) উজ্জ্বল উদ্ধারেও যত্নবান লেখক। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সাবেকী প্রাচীন সাহিত্যেরও যে আধুনিক মূল্যায়ন করা সম্ভব, এই গ্রন্থ সেই ভাবনারই সার্থক নজির।